পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SObr রবীন্দ্র-রচনাবলী মস্ত ট্রাজিডির পত্তন করলে। আমি তার আর্থিক অভাব কিছু পরিমাণে পূরণ করবার যতই চেষ্টা করেছি। কিছুতেই তাকে রাজি করতে পারিনি। মাঝে মাঝে গোপনে তাদের বাড়িতে পাঠিয়েছিটাকা। কিন্তু সে সামান্য । তখন আমার বিক্রি করবার যোগ্য যা-কিছু ছিল প্রায় সব শেষ হয়ে গেছেঅন্তঃপুরে সম্বল এবং বাইরের সম্বল। কয়েকটা আয়জনক বইয়ের বিক্রয়স্বত্ব কয়েক বৎসরের মেয়াদে দিয়েছি। পরের হাতে। হিসাবের দূর্বোিধ জটিলতায় সে মেয়াদ অতিক্রম করতে অতি দীর্ঘকাল লেগেছে। সমুদ্রতীরবাসের লোভে পুরীতে একটা বাড়ি করেছিলুম। সে বাড়ি একদিনও ভোগ করবার পূর্বে আশ্রমের ক্ষুধার দাবিতে বিক্রি হয়ে গেল। তার পরে যে সম্বল বাকি রইল তাকে বলে উচ্চহারের সুদে দেনা করবার ক্রেডিট। সতীশ জেনেশুনেই এখানকার সেই অগাধ দারিদ্র্যের মধ্যে ঝাপ দিয়েছিল প্ৰসন্ন মনে । কিন্তু তার আনন্দের অবধি ছিল না- এখানকার প্রকৃতির সংসর্গের আনন্দ, সাহিত্যসম্ভোগের আনন্দ, প্রতি মুহুর্তে আত্মনিবেদনের আনন্দ । এই অপৰ্যাপ্ত আনন্দ সে সঞ্চার করত তার ছাত্রদের মনে । মনে পড়ে কতদিন তাকে পাশে নিয়ে শালবীথিকায় পায়চারি করেছি নানা তত্ত্বের আলোচনা করতে করতে- রাত্রি এগারোটা দুপুর হয়ে যেত- সমস্ত আশ্রম হত নিস্তব্ধ নিদ্রামগ্ন । তারই কথা মনে করে আমি লিখেছি।-- কতদিন এই পাতা-ঝরা বীথিকায়, পুষ্পগন্ধে বসন্তের আগমনী-ভরা ফিরেছি গুঞ্জিত আলাপনে । তার সেই মুগ্ধ চোখে বিশ্ব দেখা দিয়েছিল নন্দন মন্দার রঙে রাঙা । । যৌবনতুফান-লাগা সেদিনের কত নিদ্রাভাঙা জ্যোৎস্না-মুগ্ধ রজনীর সীেহাদ্যের সুধারসধারা তোমার ছায়ায় মাঝে দেখা দিল, হয়ে গেল সারা । গভীর আনন্দক্ষণ কতদিন তব মঞ্জরীতে একান্ত মিশিয়াছিল একখানি অখণ্ড সংগীতে আলোকে আলাপে হাস্যে, বনের চঞ্চল আন্দোলনে, বাতাসের উদাস নিশ্বাসে ||- এমন অবিমিশ্রশ্ৰদ্ধা, অবিচলিত অকৃত্রিম গ্ৰীতি, এমন সর্বভারবাহী সর্বত্যাগী সৌহার্দ্য জীবনে কত যে দুর্লভ তা এই সত্তর বৎসরের অভিজ্ঞতায় জেনেছি। তাই সেই আমার কিশোর বন্ধুর অকাল তিরোভাবের বেদনা আজ পর্যন্ত কিছুতেই ভুলতে পারি নি। এই আশ্রমবিদ্যালয়ের সুদূর আরম্ভ-কালের প্রথম সংকল্পন, তার দুঃখ তার আনন্দ তার অভাব তার পূর্ণতা, তার প্রিয় সঙ্গ, প্রিয় বিচ্ছেদ, নিষ্ঠুর বিরুদ্ধতা ও অযাচিত আনুকূল্যের অল্পই কিছু আভাস দিলেম এই লেখায়। তার পরে শুধু আমাদের ইচ্ছা নয়, কালের ধর্ম কাজ করছে ; এনেছে কত পরিবর্তন, কত নতুন আশা ও ব্যর্থতা, কত সুহৃদের অভাবনীয় আত্মনিবেদন, কত অজানা লোকের অহৈতুক শক্রতা, কত মিথ্যা নিন্দা ও প্রশংসা, কত দুঃসাধ্য সমস্যা— আর্থিক ও পারমর্থিক। পারিতোষিক পাই বা না পাই, নিজের ক্ষতি করেছি। সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত- অবশেষে ক্লান্ত দেহ ও জীর্ণ স্বাস্থ্য নিয়ে আমারও বিদায় নেবার দিন এল— প্ৰণাম করে যাই তাকে যিনি সুদীর্ঘ কঠোর দুৰ্গম পথে আমাকে এতকাল চালনা করে নিয়ে এসেছেন। এই এতকালের সাধনার বিফলতা প্রকাশ পায় বাইরে, এর সার্থকতার সম্পূর্ণ প্রমাণ থেকে যায় অলিখিত ইতিহাসের অদৃশ্য অক্ষরে। আশ্বিন ১৩৪০