পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বভারতী । S¢ዒ রয়েছেন তাকে বিশ্বছবির মধ্যে উপলব্ধি করা, এটি মহর্ষির জীবনে প্রত্যক্ষ সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার মনে হল যে, যদি ছাত্রদের মহৰ্ষির সাধনস্থল এই শান্তিনিকেতনে এনে বসিয়ে দিতে পারি। তবে তাদের সঙ্গে থেকে নিজের যেটুকু দেবার আছে তা দিতে পারলে বাকিটুকুর জন্য আমাকে ভাবতে হবে না, প্রকৃতিই তাদের হৃদয়কে পূর্ণ করে সকল অভাব মোচন করে দিতে পারবে। প্রকৃতির সঙ্গে এই যোগের জন্য সকলের চিত্তেই যে নুনাধিক ক্ষুধার অংশ আছে তার নিবৃত্তি করবার চেষ্টা করতে হবে, যে সম্পর্শ থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে তাকে জোগাতে হবে । তখন আমার সঙ্গী-সহায় খুবই অল্প। ব্ৰহ্মবান্ধব উপাধ্যায় মহাশয় আমায় ভালোবাসতেন। আর আমার সংকল্পে শ্ৰদ্ধা করতেন । তিনি আমার কাজে এসে যোগ দিলেন । তিনি বললেন, “আপনি মাস্টারি করতে না জানেন, আমি সে ভার নিচ্ছি।” আমার উপর ভার রইল ছেলেদের সঙ্গ দেওয়া । আমি সন্ধ্যাবেলায় তাদের নিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি, হাসা-করুণ রসের উদ্রেক করে তাদের হাসিয়েছি কঁদিয়েছি। তা ছাড়া নানা গল্প বানিয়ে বলতাম, দিনের পর দিন একটি ছোটাে গল্পকে টেনে টেনে লম্বা করে। পাচ-সাত দিন ধরে একটি ধারা অবলম্বন করে চলে যেতাম । তখন মুখে মুখে গল্প তৈরি করবার আমার শক্তি ছিল । এই-সব বানানো গল্পের অনেকগুলি আমার ‘গল্পগুচ্ছে স্থান পেয়েছে। এমনি ভাবে ছেলেদের মন যাতে অভিনয়ে গল্পে গানে, রামায়ণ-মহাভারত-পাঠে সরস হয়ে ওঠে তার চেষ্টা করেছি । আমি জানি, ছেলেদের এমনি ভাবে মনের ধারা ঠিক করে দেওয়া, একটা অ্যাটিচুড তৈরি করে তোলা খুব বড়ো কথা । মানুষের যে এতবড়ো বিশ্বের মধ্যে এতবড়ো মানবসমাজে জন্ম হয়েছে, সে যে - এতবড়ো উত্তরাধিকার লাভ করেছে, এইটার প্রতি তার মনের অভিমুখিতাকে খাটি করে তোলা দরকার। আমাদের দেশের এই দুৰ্গতির দিনে আমাদের অনেকের পক্ষেই শিক্ষার শেষ লক্ষ্য হয়েছে চাকরি, বিশ্বের সঙ্গে যে আনন্দের সম্বন্ধের দ্বারা বিশ্বসম্পদকে আত্মগত করা যায় তা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। কিন্তু মানুষকে আপন অধিকারটি চিনে নিতে হবে । সে যেমন প্রকৃতির সঙ্গে চিত্তের সামঞ্জস্য সাধন করবে। তেমন তাকে বিরাট মানববিশ্বের সঙ্গে সম্মিলিত হতে হবে । আমাদের দেশবাসীরা ‘ভূমৈব সুখম' এই ঋষিবাকা ভুলে গেছে। ভূমৈব সুখং- তাই জ্ঞানতপস্বী মানব দুঃসহ ক্লেশ স্বীকার করেও উত্তর-মেরুর দিকে অভিযানে বার হচ্ছে, আফ্রিকার অভ্যন্তরপ্রদেশে দুৰ্গম পথে যাত্রা করছে, প্ৰাণ হাতে করে সত্যের সন্ধানে ধাবিত হচ্ছে । তাই কর্মজ্ঞান ও ভাবের সাধনপথের পথিকেরা দুঃখের পথ অতিবাহন করতে নিষ্ক্রান্ত হয়েছে ; তঁরা জেনেছেন যে, ভূমৈব সুখং- দুঃখের পথেই মানুষের সুখ । আজ আমরা সে কথা ভুলেছি, তাই অত্যন্ত ক্ষুদ্র লক্ষ্য ও অকিঞ্চিৎকর জীবনযাত্রার মধ্যে আত্মাকে প্রচ্ছন্ন করে দিয়ে দেশের প্রায় সকল লোকেরই কাল কাটছে । তাই শিক্ষালয় স্থাপন করবার সময়ে প্রথমেই আমার এ কথা মনে হল যে, আমাদের ছাত্রদের জীবনকে মানসিক ক্ষীণতা থেকে ভীরুতা থেকে উদ্ধার করতে হবে । যে গঙ্গার ধারা গিরিশিখর থেকে উখিত হয়ে দেশদেশান্তরে বহমান হয়ে চলেছে মানুষ তার জলকে সংসারেয় ছোটাে বড়ো সকল কাজেই লাগাতে পারে। তেমনি যে পাবনী বিদ্যাধারা কোনাে উতুঙ্গ মানবচিত্তের উৎস থেকে উদ্ভূত হয়ে অসীমের দিকে প্রবাহিত হয়ে চলছে, যা পূর্ব-পশ্চিম-বাহিনী হয়ে দিকে দিকে নিরন্তর স্বতঃউৎসারিত হচ্ছে, তাকে আমরা ক্ষুদ্র স্বাৰ্থসিদ্ধির পরিধির মধ্যে বাঁধ বেঁধে ধরে রেখে দেখব না ; কিন্তু যেখানে তা পূর্ণ মানবজীবনকে সাৰ্থক করে তুলেছে, তার সেই বিরাট বিশ্বরূপটি যেখানে পরিস্ফুট ODS LLO DB DDDD BDBBDB Bi D DBDS 'স তপোহতপত সি তপস্তপ্তলা ইদং সৰ্বমসৃজত যদিদং কিঞ্চি ।” সৃষ্টিকর্তা তপস্যা করছেন, তপস্যা করে সমস্ত সৃজন করছেন। প্রতি অণুপুরমাণুতে তার সেই তপস্যা নিহিত। সেজন্য তাদের মধ্যে নিরন্তর সংঘাত, অগ্নিবেগ, চক্রপথের আবর্তন। সৃষ্টিকর্তার এই তপঃসাধনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরাও তপস্যার ধারা চলেছে, সেও চুপ করে বসে নেই। কেননা মানুষও সৃষ্টিকর্তা, তার আসল