পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७१० রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকে না, সমাজ বিষবাম্পে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে । সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আজ তারই পরিচয় পাচ্ছি, আজি বিশ্বব্যাপী লুব্ধতা প্রবল হয়ে উঠে মানুষে মানুষে হিংস্রবুদ্ধির আগুন জ্বালিয়ে তুলেছে। এমন দিনে স্মরণ করি সেই মহাপুরুষদের র্যারা মানুষকে সোনা-রুপার ভাণ্ডারের সন্ধান দিতে আসেন নি, দুর্বলের বুকের উপর দিয়ে প্রবলের ইস্পাত-বাঁধানাে বড়ো রাস্তা পাকা করবার মন্ত্রণাদাতা যারা নন— মানুষের সব চেয়ে বড়ো সম্পদ যে মুক্তি সেই মুক্তি দান করা যাদের প্রাণপণ ব্ৰত। এমন মহাপুরুষ নিশ্চয়ই পৃথিবীতে অনেক এসেছেন, আমরা তাদের সকলের নামও জানি না। কিন্তু নিশ্চয়ই এমন অনেক আছেন এখনো যারা এই পৃথিবীকে মার্জনা করছেন, আমাদের জীবনকে সুন্দর উজ্জ্বল করছেন। বিজ্ঞানে জেনেছি, জন্তুরা যে বিষনিশ্বাস পরিত্যাগ করে গাছপালা সে নিশ্বাস গ্ৰহণ করে প্রাণদায়ী অক্সিজেন প্রশ্বসিত করে দেয়। তেমনি মানুষের চরিত্র প্রতিনিয়ত যে বিষ উদগার করছে নিয়ত তা নির্মল হচ্ছে পবিত্রজীবনের সংস্পর্শে । এই শুভচেষ্টা মানবলোকে র্যারা জাগ্রত রাখছেন তাদের যিনি প্রতীক, যদ্ভুদ্রং তন্ন আসুব এই বাণী যার মধ্যে উজ্জ্বল পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাকে প্ৰণাম করার যোগেই সেই সাধুদের সকলকে একসঙ্গে প্ৰণাম জানাই- যারা আত্মোৎসর্গের দ্বারা পৃথিবীতে কল্যাণ বিতরণ করছেন। . আজকের দিন যার জন্মদিন বলে খ্যাত সেই যিশুর নিকটই উপস্থিত করি জগতে যারা প্ৰণম্য র্তাদের সকলের উদ্দেশে প্ৰণাম। আমরা মানবের পরিপূর্ণ কল্যাণরূপ দেখতে পেয়েছি। কয়েকজনের মধ্যে। এই কল্যাণের দূত আমাদের ইতিহাসে অল্পই এসেছেন, কিন্তু পরিমাণ দিয়ে কল্যাণের বিচার তো হতে পারে না । ভারতবর্ষে উপনিষদের বাণী মানুষকে বল দিয়েছে। কিন্তু সে তো মন্ত্র, ধ্যানের বিষয়। র্যাদের জীবনে রূপ পেয়েছে। সেই বাণী তারা যদি আমাদের আপনি হয়ে আমাদের প্রত্যক্ষ হয়ে আসেন। তবে সে আমাদের মস্ত সুযোগ। কেননা শাস্ত্রবাক্য তো কথা বলে না, মানুষ বলে। আজকে আমরা যার কথা স্মরণ করছি তিনি অনেক আঘাত পেয়েছেন, বিরুদ্ধতা শক্রতার সম্মুখীন হয়েছেন, নিষ্ঠুর মৃত্যুতে তঁর জীবনান্ত হয়েছিল। এই যে পরম দুঃখের আলোকে মানুষের মনুষ্যত্ব চিরকালের মতো দেদীপ্যমান হয়ে আছে। এ তো বইপড়া ব্যাপার নয়। এখানে দেখছি মানুষকে দুঃখের আগুনে উজ্জ্বল। একে উপলব্ধি করা সহজ ; শাস্ত্ৰবাক্যকে তো আমরা ভালোবাসতে পারি নে। সহজ হয় আমাদের পথ, যদি আমরা ভালোবাসতে পারি তাদের ধারা মানুষকে ভালোবেসেছেন। বুদ্ধ যখন অপরিমেয় মৈত্রী মানুষকে দান করেছিলেন তখন তো তিনি কেবল শাস্ত্র প্রচার করেন নি, তিনি মানুষের মনে জাগ্রত করেছিলেন ভক্তি। সেই ভক্তির মধ্যেই যথার্থ মুক্তি । খৃষ্টকে যারা প্রত্যক্ষভাবে ভালোবাসতে পেরেছেন তারা শুধু একা বসে রিপু দমন করেন নি, তারা দুঃসাধ্য সাধন করেছেন। তারা গিয়েছেন দূর-দূরান্তরে, পর্বত সমুদ্র পেরিয়ে মানবপ্রেম প্রচার করেছেন। মহাপুরুষেরা এইরকম আপন জীবনের প্ৰদীপ জ্বালান ; তঁরা কেবল তর্ক করেন না, মত প্রচার করেন না । তঁরা আমাদের দিয়ে যান মানুষরূপে আপনাকে । খৃষ্ট্রর প্রেরণা মানবসমাজে আজ ছােটাে বড়ো কত প্ৰদীপ জ্বালিয়েছে, অনাথ-পীড়িতদের দুঃখ দূর করবার জন্যে তঁরা অপরিসীম ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছেন। কী দানবতা আজ চার দিকে, কলুষে পৃথিবী আচ্ছন্ন- তবু বলতে হবে : স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ। এই বিরাট কলুষনিবিড়তার মধ্যে দেখা যায় না। তাদের, যারা মানবসমাজের পুণ্যের আকর। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই আছেন— নইলে পৃথিবী অভিশপ্ত হত, সমস্ত সৌন্দৰ্য স্নান হয়ে যেত, সমস্ত মানবলোক অন্ধকারে অবলুপ্ত হত । ২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৬ চৈত্র ১৩৪৩ শান্তিনিকেতন