পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SO রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি যাহাঁদের চিনি না। তাহারা আমার কথা শুনিতেছেন, তাহারা আমার পাশে বসিয়া আছেন, আমার মনের ভিতরে চাহিয়া দেখিতেছেন। তঁহাদের ঘরকন্নার মধ্যে আমি আছি, তঁহাদের কত শত সুখ দুঃখের মধ্যে আমি জড়িত হইয়া গেছি! ইহাদের মধ্যে কেহই কি আমাকে ভালোবাসেন নাই ? কোনো জননী কি তাহার স্নেহের শিশুকে স্তনদান করিতে করিতে আমার লেখা পড়েন নাই ও সেই সঙ্গে সেই অসীম মেহের কিছু ভাগ আমাকে দেন নাই ? সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় আমার মমতা, আমার স্নেহ, সহসা কি সাত্মনার মতো কাহারও কাহারও প্ৰাণে গিয়া প্ৰবেশ করে নাই ও সেই সময়ে কি গ্ৰীতিপূর্ণ হৃদয়ে দূর হইতে আমাকে বন্ধু বলিয়া তাহারা ডাকেন নাই ? কেহ যেন না মনে করেন আমি গর্ব করিতেছি। আমার যাহা বাসনা তাহাই ব্যক্ত করিতেছি মাত্র । মনে মনে মিলন হয় এমন লোক সচরাচর কই দেখিতে পাই ? এই জন্য মনের ভাবগুলিকে যথাসাধ্য সাজাইয়া চারি দিকে পঠাইয়া দিতেছি। যদি কাহারও ভালো লাগে ! যাহারা আমার যথার্থ বন্ধু, আমার প্রাণের লোক, কেবলমাত্র দৈববশতই যাহাদের সহিত আমার কোনো কালে দেখা হয় নাই, তাহদের সহিত যদি মিলন হয় ! সেই সকল পরমান্তীয়দিগকে উদ্দেশ করিয়া আমার এই প্ৰাণের ফুলগুলি উৎসর্গ করি। আমি কল্পনা করিতেছি, পাঠকদের মধ্যে এইরূপ আমার কতকগুলি অপরিচিত বন্ধু আছেন, আমার হৃদয়ের ইতিহাস পড়িতে তঁহাদের ভালো লাগিতেও পারে । তাহারা আমার লেখা লইয়া অকারণ তর্ক-বিতর্ক অনর্থক সমালোচনা করিবেন না, তাহারা কেবল আমাকে চিনিবেন ও পড়িবেন । যদি এ কল্পনা মিথ্যা হয় তো হীেক, কিন্তু ইহারই উপর নির্ভর করিয়া আমার লেখা প্ৰকাশ করি । নহিলে কেবলমাত্র শকুনি গৃধিনীদের দ্বারা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিবার জন্য নির্মমতার অনাবৃত শ্মশানক্ষেত্রের মধ্যে নিজের হৃদয়খানা কে ফেলিয়া রাখিতে পারে ? আর, আমার পাঠকদিগের মধ্যে একজন লোককে বিশেষ করিয়া আমার এই ভাবগুলি উৎসর্গ করিতেছি ।- এ ভাবগুলির সহিত তোমাকে আরো কিছু দিলাম, সে তুমিই দেখিতে পাইবে । সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে ? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ ? সেই জ্যোৎস্নালোক ? সেই দুই জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ ? সেই মৃদু গভীর স্বরে গভীর আলোচনা ? সেই দুই জনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা ? সেই প্ৰভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া ! এক দিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান ? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে ! কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির মধ্যে কিছু দিনের গােটকতক সুখ দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক-একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের মেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না ! আমার এই লেখার মধ্যে লেখা রহিল- এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে |