পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8vb^ রবীন্দ্র-রচনাবলী এবং পৃথিবীর সকলের আশার অতীত না হইলে, আমি তাহাদের চোখের জল মুছাইবার অবসর পাইব না । এই বলিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল। বিনোদিনী একলা পড়িয়া আপনার চারিদিকে যে মোহজাল রচনা করিতেছিল, তাহ সমস্ত ছিড়িয়া দিয়া গেল । চুপ করিয়া দাড়াইয়া বিনোদিনী বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল— আকাশভরা জ্যোংক্ষা শূন্ত করিয়া দিয়া তাহার সমস্ত স্থধারস কোথায় উবিয়া গেছে । সেই কেয়ারি-করা বাগান, তাহার পরে বালুকাতৗর, তাহার পরে নদীর কালে জল, তাহার পরে ওপারের অক্ষুটতা— সমস্তই যেন একখানা বড়ো সাদা কাগজের উপরে পেনসিলেঅঁাকা একটি চিত্র মাত্ৰ— সমস্তই নীরস এবং নিরর্থক । মহেন্দ্রকে বিনোদিনী কিরূপ প্রবলবেগে আকর্ষণ করিয়াছে, প্রচণ্ড ঝড়ের মতো কিরূপ সমস্ত শিকড়-মৃদ্ধ তাহাকে উৎপাটিত করিয়াছে, আজ তাহা অনুভব করিয়া তাহার হৃদয় আরো যেন অশাস্ত হইয়া উঠিল । তাহার তো এই সমস্ত শক্তিই রহিয়াছে, তবে কেন বিহারী পূর্ণিমার রাত্রির উদবেলিত সমুদ্রের ন্যায় তাহার সম্মুখে আসিয়া ভাঙিয়া পড়ে না। কেন একটা অনাবশ্যক ভালোবাসার প্রবল অভিঘাত প্রত্যহ তাহার ধ্যানের মধ্যে আসিয়া কাদিয়া পড়িতেছে । আর-একটা আগন্তুক রোদন বারংবার আসিয়া তাহার অস্তরের রোদনকে কেন পরিপূর্ণ অবকাশ দিতেছে না। এই যে একটা প্রকাও আন্দোলনকে সে জাগাইয়া তুলিয়াছে, ইহাকে লষ্টয়া সমস্ত জীবন সে কী করিবে । এখন ইহাকে শাম্ভ করিবে কী উপায়ে । আজ যে-সমস্ত ফুলের মালায় সে নিজেকে ভূষিত করিয়াছিল, তাহার উপরে মহেঞ্জের মুগ্ধ দৃষ্টি পড়িয়াছিল জানিয়া সমস্ত টানিয়া ছিড়িয়া ফেলিল । তাহার সমস্ত শক্তি বৃথা, চেষ্টা বৃথা, জীবন বৃথা— এই কানন, এই জ্যোৎস্না, এই যমুনাতট, এই অপূর্বমুন্দর পৃথিবী, সমস্তই বৃথা । এত ব্যর্থতা, তবু যে যেখানে সে সেখানেই দাড়াইয়া আছে– জগতে কিছুরই লেশমাত্র ব্যত্যয় হয় নাই। তবু কাল স্বর্য উঠিবে এবং সংসার তাহার ক্ষুদ্রতম কাজটুকু পর্যন্ত তুলিবে না— এবং অবিচলিত বিহারী যেমন দূরে ছিল, তেমনি দূরে থাকিয়া ব্রাহ্মণ-বালককে তাহার বোধোদয়ের নূতন পাঠ অভ্যাস করাইবে । বিনোদিনীর চক্ষু ফাটিয়া অশ্রু বাহির হইয়া পড়িল । সে তাহার সমস্ত বল ও আকাঙ্ক্ষা লইয়া কোন পাথরকে ঠেলিতেছে । তাহার হৃদয় রক্তে ভাসিয়া গেল, কিন্তু তাহার অদৃষ্ট স্বচ্যগ্রপরিমাণ সরিয়া বসিল না।