পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি NR) ( q এইবার আলিপুরে ওকালতির কাজ শুরু করিয়া দিবে, রমেশের এইরূপ সংকল্প ছিল । কিন্তু তাহার মন ভাঙিয়া গেছে। চিত্ত স্থির করিয়া কাজে হাত দিবার এবং প্রথম কাৰ্যারম্ভের নানা বাধাবিঘ্ন অতিক্রম কবিবার মতো স্মৃর্তি তাহার ছিল না । সে এখন কিছুদিন গঙ্গার পোলের উপর এবং গোলদিঘিতে অনাবশাক ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল ৷ একবার মনে করিল ‘কিছুদিন পশ্চিমে ভ্ৰমণ করিয়া আসি, এমন সময় অন্নদাবাবুর কাছ হইতে একখানি চিঠি পাইল । অন্নদাবাবু লিখিতেছেন, “ গেজেটে দেখিলাম, তুমি পাস হইয়াছ- কিন্তু সে খবর তোমার নিকট হইতে না পাইয়া দুঃখিত হইলাম । বহুকাল তোমার কোনো সংবাদ পাই নাই । তুমি কেমন আছ এবং কবে কলিকাতায় আসিবে, জানাইয়া আমাকে নিশ্চিন্ত ও সুখী করিবে ।” এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না যে, অন্নদাবাবু যে বিলাতগত ছেলেটির পরে তাহার চক্ষু রাখিয়াছিলেন, সে ব্যারিস্টার হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে এবং এক ধনিকন্যার সহিত তাহার বিবাহের আয়োজন চলিতেছে । ইতিমধ্যে যে-সমস্ত ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার পরে হেমনলিনীর সহিত পূর্বের ন্যায় সাক্ষাৎ করা তাহার কর্তবা হইবে কি না, তাহা বমেশ কোনোমতেই স্থির করিতে পারিল না । সম্প্রতি কমলার সহিত তাহার যে সম্বন্ধ দাড়াইয়াছে, সে কথা কাহাকেও বলা সে কর্তব্য বোধ করে না । নিরপরাধা কমলাকে সে সংসারের কাছে অপদস্থ করিতে পারে না । অথচ সকল কথা স্পষ্ট না বলিয়া হেমনলিনীর নিকট সে তাহার পূর্বের অধিকার লাভ করিবে কী করিয়া ? কিন্তু অন্নদাবাবুর পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব করা আর তো উচিত হয় না । সে লিখিল, “গুরুতর কারণ-বশত আপনাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে অক্ষম হইয়াছি, আমাকে মার্জনা করিবেন ।” নিজের নতুন ঠিকানা পত্রে দিল না । এই চিঠিখনি ডাকে ফেলিয়া তাহার পরদিনেই রমেশ শামলা মাথায় দিয়া আলিপুরের আদালতে হাজির দিতে বাহির হইল । একদিন সে আদালত হইতে ফিরিবার সময় কতক পথ ঠাটিয়া একটি ঠিকাগাড়ির গাডোয়ানের সঙ্গে ভাড়ার বন্দোবস্ত করিতেছে, এমন সময় একটি পরিচিত ব্যগ্ৰকণ্ঠের স্বরে শুনিতে পাইল, “বাবা, এই যে, রমেশবাবু ?” “গাডোয়ান, রোখো রোখো৷ ” গাড়ি রমেশের পার্শ্বে আসিয়া দাড়াইল । সেদিন আলিপুরের পশুশালায় একটি চড়িভাতির নিমন্ত্রণ সারিয়া অন্নদাবাবু” ও তাহার কন্যা বাড়ি ফিরিতেছিলেন- এমন সময়ে হঠাৎ এই সাক্ষাৎ । গাড়িতে হেমনলিনীর সেই স্নিগ্ধগম্ভাব মুখ, তাহার বিশেষ ধরনেব সেই শাড়ি পরা, তাহার চুল বাধিবার পরিচিত ভঙ্গি, তাহার হাতের সেই প্লেন বালা এবং তারাকাটা দুইগাছি করিয়া সোনার চুড়ি দেখিবামাত্র রমেশের বুকের মধ্যে একটা ঢেউ যেন একেবারে কণ্ঠ পর্যন্ত উচ্ছসিত হইল । অন্নদাবাবু কহিলেন, “এই যে রমেশ, ভাগ্যে পথে দেখা হইল ! আজিকাল চিঠি লেখাই বন্ধ করিয়াছ, যদি বা লেখ, তবু ঠিকানা দাও না । এখন যাইতেছ। কোথায় % বিশেষ কোনো কাজ আছে ?” রমেশ কহিল, “না, আদালত হইতে ফিরিতেছি ।” অন্নদা ! তবে চলো, আমাদের ওখানে চা খাইবে চলো । রমেশের হৃদয় ভরিয়া উঠিয়াছিল— সেখানে আর দ্বিধা করিবার স্থান ছিল না । সে গাড়িতে চড়িয়া বসিল | একান্ত চেষ্টায় সংকোচ কাটাইয়া হেমনলিনীকে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি ভালো আছেন ?” হেমনলিনী কুশলপ্রশ্নের উত্তর না দিয়াই কহিল, “আপনি পাস হইয়া আমাদের যে একবার খবর দিলেন না বড়ো ?” রমেশ এই প্রশ্নের কোনো জবাব খুজিয়া না পাইয়া কহিল, “আপনিও পাস হইয়াছেন দেখিলাম।”