পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏔbᎶ: 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সুপ্রিশ্ন দিলেন। এই আশীৰ্ত্তরে ও আদরে হেফাস্টর হৃদয় একটি সুগন্ধীর মাধুর্য পরিপূর্ণ হইয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বেয়াইমশায়, কাল আমার ওখানে আপনাদের দুজনেরই সকালে নিমন্ত্রণ রহিল ।” পরদিন প্ৰাতঃকালে হেমনলিনীকে লইয়া অন্নদাবাবু যথানিয়মে বাহিরে চা খাইতে বসিয়াছেন। অন্নদাবাবুর রোগক্লিষ্ট মুখ এক রাত্রির মধ্যেই আনন্দে সরস ও নবীন হইয়া উঠিয়াছে। ক্ষণে ক্ষণে হেমনলিনীর শাস্তোজ্বল মুখের দিকে চাহিতেছেন আর র্তাহার মনে হইতেছে, আজ যেন তাহার পরলোকগতা পত্নীর মঙ্গলমধুর আবির্ভাব তাহার কন্যাকে পরিবেষ্টিত করিয়া রহিয়াছে এবং সুদূরব্যাপ্ত অশ্রুজিলের আভাসে সুখের অত্যুজ্বলতাকে স্নিগ্ধগভীর করিয়া তুলিয়াছে। অন্নদাবাবুর আজ কেবলই মনে হইতেছে, ক্ষেমংকরীর নিমন্ত্রণে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইবার সময় হইয়াছে, আর দেরি করা উচিত নহে। হেমনলিনী তাহাকে বার বার করিয়া স্মরণ করাইতেছে, এখনো অনেক সময় আছে, এখনো সবে আটটা । অন্নদাবাবু কহিতেছেন, “নাহিয়া প্ৰস্তুত হইয়া লইতে তো সময় চাই। দেরি করার চেয়ে বরঞ্চ একটু সকাল-সকাল যাওয়া ভালো।” ইতিমধ্যে কতকগুলি তোরঙ্গ বিছানা প্রভৃতি বোঝাই-সমেত এক ভাড়াটে গাড়ি আসিয়া বাগানের প্রবেশপথের সম্মুখে থামিল । সহসা হেমনলিনী “দাদা আসিয়াছেন” বলিয়া অগ্রসর হইয়া গেল। যোগেন্দ্ৰ হাস্যমুখে গাড়ি হইতে নামিল ; কহিল, “কী হেম, ভালো আছ তো ?” হেমনলিনী জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার গাড়িতে আর-কেহ আছে নাকি ?” যোগেন্দ্ৰ হাসিয়া কহিল, “আছে বৈকি। বাবার জন্য একটি ক্রিস্টমাসের উপহার আনিয়াছি।” ইতিমধ্যে রমেশ গাড়ি হইতে নামিয়া পড়িল । হেমনলিনী একবার মুহুর্তকাল চাহিয়াই তৎক্ষণাৎ পশ্চাৎ ফিরিয়া চলিয়া গেল । যোগেন্দ্ৰ ডাকিল, “হেম, যেয়ে না, কথা আছে, শোনো ।” এ আহবান হেমনলিনীর কানেও পৌছিল না, সে যেন কোন প্রেতিমূর্তির অনুসরণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য দ্রুতবেগে চলিল । রমেশ ক্ষণকালের জন্য একবার থমকিয়া দাড়াইল ; অগ্রসর হইবে কী ফিরিয়া যাইবে ভাবিয়া পাইল না । যোগেন্দ্ৰ কহিল, “রামেশা, এসো, বাবা এইখানে বাহিরেই বসিয়া আছেন।” বলিয়া রমেশের হাত ধরিয়া তাহাকে অন্নদাবাবুর কাছে আনিয়া উপস্থিত করিল। অন্নদাবাবু দূর হইতেই রমেশকে দেখিয়া হতবুদ্ধি হইয়া গেছেন। তিনি মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে ভাবিলেন, এ আবার কী বিঘ্ন উপস্থিত হইল! যোগেন্দ্রকে কহিলেন, “যোগেন, তুমি ঠিক সময়েই আসিয়ােছ। আমি তোমাকে টেলিগ্রাফ করিব মনে করিতেছিলাম।” যোগেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ?” অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেমের সঙ্গে নলিনাক্ষের বিবাহ স্থির হইয়া গেছে। কাল নলিনাক্ষের মা হেমকে আশীৰ্বাদ করিয়া দেখিয়া গেছেন।” যোগেন্দ্র । বল কী বাবা, বিবাহ একেবারে পাকাপাকি স্থির হইয়া গেছে ? আমাকে একবার জিজ্ঞাসা করিতেও নাই ? অন্নদাবাবু। যোগেন্দ্ৰ, তুমি কখন কী বল তার কিছুই স্থির নাই। আমি যখন নলিনাক্ষকে জানিতামও না তখন তোমরাই তো এই বিবাহের জন্য উদয়োগী ছিলে। যোগেন্দ্র । তখন তো ছিলাম, কিন্তু তা যাই হােক, এখনো সময় যায় নাই । ঢের কথা বলিবার আছে। আগে সেইগুলো শোনাে, তার পরে যা কর্তব্য হয় করিয়াে।