পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9(r\ኃ রবীন্দ্র-রচনাবলী এই বুঝিয়া একাগ্রামনে বারবার করিয়া সে সংকল্প করিতে লাগিল, “আমি কাল হইতে যেন কোনো দুঃখকে মনে স্থান না দিই, যেন এক মুহূর্ত মুখ বিরস না করি, যাহা আশার অতীত, তাহার জন্য যেন কোনাে কামনা মনের মধ্যে না থাকে। কেবল সেবা করিব, যতদিন জীবন আছে কেবল সেবা করিব, আর-কিছু চাহিব না— চাহিব না- চাহিব না।” তাহার পরে কমলা শুইতে গেল। এ পাশ-ও পাশ করিতে করিতে ঘুমাইয়া পড়িল। রাত্রে দুই-তিন বার ঘুম ভাঙিয়া গেল। ভাঙিবামােত্রই সে মন্ত্রের মতো আওড়াইতে লাগিল, “আমি কিছুই চাহিব না, চাহিব না, চাহিব না।” ভোরের বেলায় সে বিছানা হইতে উঠিয়াই জোড়হাত করিয়া বসিল এবং সমস্ত মুম্বকীয়া কহিল,"আমি আহুকাল তােমাৰ সব করি আর ক্সি চাৰি ন-চাৰিব। ' এই বলিয়া তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুইয়া, বাসি কাপড় ছাড়িয়া, নলিনাক্ষের সেই ক্ষুদ্র উপাসনা-ঘরের মধ্যে গেল ; নিজের আঁচলটি দিয়া সমস্ত ঘর মুছিয়া পরিষ্কার করিল এবং যথাস্থানে আসনটি বিছাইয়া রাখিয়া দ্রুতপদে গঙ্গাস্নান করিতে গেল। আজকাল নলিনাক্ষের একান্ত অনুরোধে ক্ষেমংকরী সূর্যোদয়ের পূর্বে স্নান করিতে যাওয়া পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাই উমেশকেই এই দুঃসহ শীতের ভোরে কমলার সহিত স্নানে যাইতে হইল । স্নান হইতে ফিরিয়া আসিয়া কমলা ক্ষেমংকরীকে প্ৰফুল্লমুখে প্ৰণাম করিল। তিনি তখন স্নানে বাহির হইবার উপক্ৰম করিতেছিলেন । কমলাকে কহিলেন, “এত ভোরে কেন নাহিতে গেলে ? আমার সঙ্গে গেলেই তো হইত ।” কমলা কহিল, “আজ যে কাজ আছে মা ! কাল সন্ধ্যাবেলায় যে তরকারি আনানো হইয়াছে তাহাই কুটিয়া রাখি ; আর যা-কিছু বাজার করা বাকি আছে, উমেশ সকাল-সকাল সারিয়া আসুক।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “বেশ বুদ্ধি ঠাওরাইয়াছ মা | বেয়াই যেমনি আসিবেন আমনি খাবার প্রস্তুত পাইবেন ।” এমন সময় নলিনাক্ষ বাহির হইয়া আসিবামাত্র কমলা ভিজা চুলের উপর তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল । নলিনাক্ষ কহিল, “মা, আজই তুমি স্নান করিতে চলিলে ? সবে কাল একটু ভালো ছিলে ।” ক্ষেমংকরী কহিলেন, “নলিন, তোর ডাক্তারি রাখা। সকালবেলায় গঙ্গাস্নান না করিলেও লোকে অমর হয় না। তুই এখন বাহির হইতেছিস বুঝি ? একটু সকাল-সকাল ফিরিস।” নলিনাক্ষ জিজ্ঞাসা করিল, “কোন মা ?” ক্ষেমংকরী। কাল তোকে বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিলাম, আজ অন্নদাবাবু তোকে আশীর্বাদ করিতে আসিবেন । নলিনাক্ষ । আশীর্বাদ করিতে আসিবেন ? কেন, হঠাৎ আমার উপরে এত বিশেষভাবে প্ৰসন্ন হইলেন যে ? তার সঙ্গে তো রোজই আমার দেখা হয় । ক্ষেমংকরী । আমি যে কাল হেমনলিনীকে একজোড়া বালা দিয়া আশীৰ্বাদ করিয়া আসিলাম, এখন অন্নদাবাবু তোকে না করিলে চলিবে কেন ? যা হােক, ফিরিতে দেরি করিস নে, তারা এখানেই খাইবেন । এই বলিয়া ক্ষেমংকরী স্নান করিতে গেলেন। নলিনাক্ষ মাথা নিচু করিয়া ভাবিতে ভাবিতে রাস্তা দিয়া চলিয়া গেল । (፩br হেমনলিনী রমেশের নিকট হইতে দ্রুতবেগে পলায়ন করিয়া ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িল। প্ৰথম আবেগটা শান্ত হইবামাত্র একটা লজ্জা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া দিল । "কেন আমি রমেশবাবুর সঙ্গে সহজভাবে দেখা করিতে পারিলাম না ? যাহা আশা করি না, তাহাই হঠাৎ