পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○と রবীন্দ্র-রচনাবলী সেদিন সুচরিতার দুই-একটি কথা শুনিয়া যখন হঠাৎ তিনি বুঝিতে পারিলেন সেও তাঁহাকে বিচার করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতে অবিচলিত গান্তীর্য ও স্থৈর্য রক্ষা করা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। ইতিমধ্যে যে দুই-একবার সুচরিতার সঙ্গে তাহার দেখা হইয়াছে পূর্বের ন্যায় নিজের গীেরব তিনি অনুভব ও প্রকাশ করিতে পারেন নাই। সুচরিতার সঙ্গে তাহার কথায় ও আচরণে একটা কলহের ভাব দেখা দিয়াছে। তাহাকে লইয়া অকারণে বা ছােটাে ছােটাে উপলক্ষ ধরিয়া খুঁতখুঁত করিয়াছেন। তৎসত্ত্বেও সুচরিতার অবিচলিত ঔদাসীন্যে র্তাহাকে মনে মনে হার মানিতে হইয়াছে এবং নিজের মর্যাদাহানিতে বাড়িতে আসিয়া পরিতাপ করিয়াছেন। যাহা হউক, সুচরিতার শ্রদ্ধাহীনতার দুই-একটা লক্ষণ দেখিয়া হারানবাবুর পক্ষে তাহার পরীক্ষকের উচ্চ আসনে দীর্ঘকাল স্থির হইয়া বসিয়া থাকা শক্ত হইয়া উঠিল। পূর্বে এত ঘন ঘন পরেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করিতেন না- সুচরিতার প্রেমে তিনি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন, পাছে তাহাকে এইরূপ কেহ সন্দেহ করে এই আশঙ্কায় তিনি সপ্তাহে কেবল একবার করিয়া আসিতেন এবং সুচরিতা যেন তাহার ছাত্রী এমনিভাবে নিজের ওজন রাখিয়া চলিতেন । কিন্তু এই কয়দিন হঠাৎ কী হইয়াছে— হারানবাবু তুচ্ছ একটা ছুতা লইয়া দিনে একাধিক বারও আসিয়াছেন এবং ততোধিক তুচ্ছ ছুতা ধরিয়া সুচরিতার সঙ্গে গায়ে পড়িয়া আলাপ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। পরেশবাবুও এই উপলক্ষে উভয়কে ভালো করিয়া পর্যবেক্ষণ করিবার অবকাশ পাইয়াছেন এবং তঁহার সন্দেহও ক্রমে ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে । έ পানুবাবু, আপনি আমাদের সুচরিতাকে বিবাহ করবেন। এই কথা সকলেই বলে, কিন্তু আপনার মুখ থেকে তো কোনোদিন কোনো কথা শুনতে পাই নে । যদি সত্যিই আপনার এরকম অভিপ্ৰায় থাকে তা হলে স্পষ্ট করে বলেন না কেন ?” হারানবাবু আর বিলম্ব করিতে পারিলেন না। এখন সুচরিতাকে তিনি কোনোমতে বন্দী করিতে পারিলেই নিশ্চিন্ত হন— তাহার প্রতি ভক্তি ও ব্রাহ্মসমাজের হিতকল্পে যোগ্যতার পরীক্ষা পরে করিলেও চলিবে । হারানবাবু বরদাসুন্দরীকে কহিলেন, “এ কথা বলা বাহুল্য বলেই বলি নি । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আপনার আবার একটু বাড়াবাড়ি আছে। আমরা তো চােদ্দ বছর হলেই যথেষ্ট মনে করি ।” সেদিন চা খাইবার সময় পরেশবাবু সুচরিতার ভাব দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। সুচরিতা হারানবাবুকে এত যত্ন-অভ্যর্থনা অনেক দিন করে নাই। এমন-কি, হারানবাবু যখন চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিতেছিলেন তখন র্তাহাকে লাবণ্যের নূতন একটা শিল্পকলার পরিচয় দিবার উপলক্ষে আরো একটু বসিয়া থাকিতে অনুরোধ করিয়াছিল। " পরেশবাবুর মন নিশ্চিন্ত হইল। তিনি ভাবিলেন, তিনি ভুল করিয়াছেন। এমন-কি, তিনি মনে মনে একটু হাসিলেন। ভাবিলেন, এই দুই জনের মধ্যে হয়তো নিগুঢ় একটা প্রণয়কলহ ঘটিয়াছিল, আবার সেটা মিটমাট হইয়া গেছে। সেইদিন বিদায় হইবার সময় হারান পরেশবাবুর কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাড়িলেন। জানাইলেন, এ সম্বন্ধে বিলম্ব করিতে র্তাহার ইচ্ছা নাই | পরেশবাবু একটু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কিন্তু আপনি যে আঠারো বছরের কমে মেয়েদের বিয়ে হওয়া অন্যায় বলেন । এমন-কি, আপনি কাগজেও সে কথা লিখেছেন ।” হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতার সম্বন্ধে এ কথা খাটে না। কারণ, ওর মনের যেরকম পরিণতি হয়েছে অনেক বড়ো বয়সের মেয়েরও এমন দেখা যায় না।” পরেশবাবু প্রশান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কহিলেন, “তা হােক পানুবাবু। যখন বিশেষ কোনাে অহিত দেখা যাচ্ছে না। তখন আপনার মত অনুসারে রাধারানীর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই কর্তব্য ।”