পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 \Obt রবীন্দ্র-রচনাবলী পাছে গোরা আসিয়া ডাক্তারি মতে চিকিৎসা করিবার জন্য জেদ করে এই ভয়ে নন্দর মা কিছুতেই গোরাকে খবর পাঠাইতে দেয় নাই । সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় বিনয় কহিল, “কী মুঢ়তা, আর তার কী ভয়ানক শান্তি!” গোরা কহিল, “এই মূঢ়তাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে তুমি নিজে এর বাইরে আছ মনে করে সান্তন লাভ কোরো না বিনয় । এই মূঢ়তা যে কত বড়ো আর এর শাস্তি যে কতখানি তা যদি স্পষ্ট করে দেখতে পেতে, তা হলে ঐ একটা আক্ষেপেক্তি মাত্র প্রকাশ করে ব্যাপারটাকে নিজের কাছ থেকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করতে না ।” মনের উত্তেজনার সঙ্গে গোরার পদক্ষেপ ক্রমশই দ্রুত হইতে লাগিল । বিনয় তাহার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া তাহার সঙ্গে সমান পা রাখিয়া চলিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইল । গোরা বলিতে লাগিল, “সমস্ত জাত মিথ্যার কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়ে রেখেছে। দেবতা, অপদেবতা, পেচো, হাঁচি, বৃহস্পতিবার, ত্র্যহস্পৰ্শ- ভয় যে কত তার ঠিকানা নেই- জগতে সত্যের সঙ্গে কী রকম পৌরুষের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় তা এরা জানবে কী করে ? আর তুমি-আমি মনে করছি যে আমরা যখন দু-পাতা বিজ্ঞান পড়েছি তখন আমরা আর এদের দলে নেই। কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জেনো চার দিকের হীনতার আকর্ষণ থেকে অল্প লোক কখনোই নিজেকে বই-পড়া বিদ্যার দ্বারা বঁচিয়ে রাখতে পারে না। এরা যতদিন পর্যন্ত জগদব্যাপারের মধ্যে নিয়মের আধিপত্যকে বিশ্বাস না করবে, যতদিন পর্যন্ত মিথ্যা ভয়ের দ্বারা জড়িত হয়ে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষিত লোকেরাও এর প্রভাব ছাড়াতে পারবে না।” বিনয় কহিল, “শিক্ষিত লোকেরা ছাড়াতে পারলেই বা তাতে কী ! কজনই বা শিক্ষিত লোক ! শিক্ষিত লোকদের উন্নত করবার জন্যেই যে অন্য লোকদের উন্নত হতে হবে তা নয়- বরঞ্চ অন্য লোকদের বড়ো করবার জন্যেই শিক্ষিত লোকদের শিক্ষার গৌরব ।” গোরা বিনয়ের হাত ধরিয়া কহিল, “আমি তো ঠিক ঐ কথাই বলতে চাই । কিন্তু তোমরা নিজেদের ভদ্রতা ও শিক্ষার অভিমানে সাধারণের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে দিব্য নিশ্চিন্ত হতে পারো এটা আমি বারংবার দেখেছি বলেই তোমাদের আমি সাবধান করে দিতে চাই যে, নীচের লোকদের নিস্কৃতি না দিলে কখনোই তোমাদের যথার্থনিস্কৃতি নই। নীেকার খোলে যদি ছিদ্র থাকে। তবে নীেকার মাস্তুল কখনােই গায়ে ফু দিয়ে বেড়াতে পারবে না, তা তিনি যতই উচ্চে থাকুন-না কেন ।” বিনয় নিরুত্তরে গোরার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল । গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া চলিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, “না, বিনয়, এ আমি কিছুতেই সহজে সহা করতে পারব না। ঐ-যে ভূতের ওঝা এসে আমার নন্দকে মেরে গেছে তার মার আমাকে লাগছে, আমার সমস্ত দেশকে লাগছে। আমি এই সব ব্যাপারকে এক-একটা ছােটাে এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে কোনোমতেই দেখতে পারি। নে ৷” তথাপি বিনয়কে নিরুত্তর দেখিয়া গোরা গৰ্জিয়া উঠিল, “বিনয়, আমি বেশ বুঝতে পারছি তুমি মনে মনে কী ভাবছ। তুমি ভাবছ। এর প্রতিকার নেই কিংবা প্ৰতিকারের সময় উপস্থিত হতে অনেক বিলম্ব আছে। তুমি ভাবছি, এই যে-সমস্ত ভয় এবং মিথ্যা সমস্ত ভারতবর্ষকে চেপে দাড়িয়ে রয়েছে, ভারতবর্ষের এ বোঝা হিমাচলের মতো বোঝা, একে ঠেলে টলাতে পারবে কে ? কিন্তু আমি এরকম করে ভাবতে পারি নে, যদি ভাবতুম তা হলে বাঁচতে পারতুম না। যা-কিছু আমার দেশকে আঘাত করছে তার প্রতিকার আছেই, তা সে যতবড়ো প্রবল হােক- এবং একমাত্র আমাদের হাতেই তার প্রতিকার আছে এই বিশ্বাস আমার মনে দৃঢ় আছে বলেই আমি চারিদিকের এত দুঃখ দুৰ্গতি অপমান সহ্য করতে পারছি।” YA বিনয় কহিল, “এতবড়ো দেশজোড়া প্ৰকাণ্ড দুৰ্গতির সামনে বিশ্বাসকে খাড়া করে রাখতে আমার সাহসই হয় না ।” গোরা কহিল, “অন্ধকার প্রকাণ্ড আর প্রদীপের শিখা ছোটাে । সেই এতবড়ো অন্ধকারের চেয়ে