পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8&V) লাগিল, “দিদি, আমরা এখান থেকে কলকাতায় ফিরে যাই, আজ তো ম্যাজিষ্ট্রেটের ওখানে যেতে পারব না ।” সুচরিতা অনেকক্ষণ এ কথার কোনো উত্তর করিল না। ললিতা যখন বার বার বলিতে লাগিল তখন সে বিছানায় উঠিয়া বসিল, “সে কী করে হবে ভাই ? আমার তো একেবারেই আসবার ইচ্ছা ছিল না— বাবা যখন পাঠিয়ে দিয়েছেন তখন যেজন্যে এসেছি তা না সেরে যেতে পারব না।” ললিতা কহিল, “বাবা তো এসব কথা জানেন না- জানলে কখনোই আমাদের থাকতে বলতেন । न ||' সুচরিতা কহিল, “তা কি করে জািনব ভাই!” ললিতা। দিদি, তুই পারবি ? কী করে যাবি বল দেখি! তার পরে আবার সাজগােজ করে স্টেজে দাঁড়িয়ে কবিতা আওড়াতে হবে। আমার তো জিব ফেটে গিয়ে রক্ত পড়বে। তবু কথা বের হবে না। সুচরিতা কহিল, “সে তো জানি বোন ! কিন্তু নরকযন্ত্রণাও সইতে হয়। এখন আর কোনো উপায় নেই। আজকের দিন জীবনে আর কখনো ভুলতে পারব না।” সুচরিতার এই বাধ্যতায় ললিতা রাগ করিয়া ঘুর হইতে বাহির হইয়া আসিল। মাকে আসিয়া কহিল, “মা, তোমরা যাবে না ?” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তুই কি পাগল হয়েছিস ? রাত্তির নটার পর যেতে হবে।” ললিত কহিল, “আমি কলকাতায় যাবার কথা বলছি।” বরদাসুন্দরী । শোনো একবার মেয়ের কথা শোনো ! ললিতা সুধীরকে কহিল, “সুধীরদা, তুমিও এখানে থাকবে ?” গােরার শাস্তি সুধীরের মনকে বিকল করিয়া দিয়াছিল, কিন্তু বড়ো বড়ো সাহেবের সম্মুখে নিজের বিদ্যা প্রকাশ করিবার প্রলোভন সে ত্যাগ করিতে পারে এমন সাধ্য তাহার ছিল না। সে অব্যক্তস্বরে কী একটা বলিল- বোঝা গেল সে সংকোচ বোধ করিতেছে, কিন্তু সে থাকিয়াই যাইবে । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “গোলমালে বেলা হয়ে গেল। আরদেরি করলে চলবে না। এখন সাড়েপাঁচটা পর্যন্ত বিছানা থেকে কেউ উঠতে পারবে না-বিশ্রাম করতে হবে। নইলে ক্লান্ত হয়ে রাত্রে মুখ শুকিয়ে যাবে— দেখতে বিশ্ৰী হবে।” এই বলিয়া তিনি জোর করিয়া সকলকে শয়নঘরে পুরিয়া বিছানায় শোওয়াইয়া দিলেন। সকলেই মুলগুলি কেবল কৃতির ঘুৰাইলন এবং অন দ্বার ললিতা তাহার বিস্কার উপরে উঠিয়া য়া রহিল। স্টীমারে ঘন ঘন বাঁশি বাজিতে লাগিল । স্টীমার যখন ছাড়িবার উপক্ৰম করিতেছে, খালসিরা সিঁড়ি তুলিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে, এমন সময় জাহাজের ডেকের উপর হইতে বিনয় দেখিল একজন ভদ্রস্ত্রীলোক জাহাজের অভিমুখে দ্রুতপদে আসিতেছে। তাহার বেশভূষা প্রভৃতি দেখিয়া তাহাকে ললিতা বলিয়াই মনে হইল, কিন্তু বিনয় সহসা তাহা বিশ্বাস করিতে পারিল না। অবশেষে ললিতা নিকট আসিতে আর সন্দেহ রহিল না। একবার মনে করিল ললিতা তাহাকে ফিরাইতে আসিয়াছে, কিন্তু ললিতাই তো ম্যাজিষ্ট্রেটের নিমন্ত্রণে যোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল। ললিতা স্টীমারে উঠিয়া পড়িল— খালাসি সিঁড়ি তুলিয়া লইল। বিনয় শঙ্কিতচিত্তে উপরের ডেক হইতে নীচে নামিয়া ললিতার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। ললিতা , “আমাকে উপরে নিয়ে চলুন।” বিস্মিত হইয়া কহিল, “জাহাজ যে ছেড়ে দিচ্ছে।” কহিল, “সে আমি জানি।” বিনয়ের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই সম্মুখের সিঁড়ি বাহিয়া উপরের তলায় উঠিয়া গেল। র বাঁশি ফুকিতে যুঁকিতে ছাড়িয়া দিল। " য়। ললিতাকে ফাস্ট ক্লাসের ডেকে কেদারায় বসাইয়া নীরর প্রশ্নে তাহার মুখের দিকে চাহিল।