পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V2Qや রবীন্দ্র-রচনাবলী নাই এবং আর-কাহারও কাছে কোনোদিনই এমন করিয়া প্রকাশিত হইতে পারে না । সে কী আশ্চর্য! সে কী অপরূপ ! রহস্যনিকেতনের অন্তরতম কক্ষে সে কোন অনির্বচনীয় সত্তাকে দেখা গেছে! মানুষকে এমন করিয়া কয়বার দেখা যায় এবং কয়জনকে দেখা যায় ! দৈবের যোগেই সুচরিতাকে যে ব্যক্তি এমন প্রগাঢ় সত্যরূপে দেখিয়ছে, নিজের সমস্ত প্রকৃতি দিয়া তাহাকে অনুভব করিয়াছে, সেই তো সুচরিতাকে পাইয়াছে। আর-কেহ আর-কখনো তাহাকে পাইবে কেমন করিয়া ? হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানী কি চিরদিন এমনি আইবুড়ো থেকেই যাবে ! এও কি কখনো হয় ।” সেও তো বটে। কাল যে গােরা প্ৰায়শ্চিত্ত করিতে যাইতেছে। তাহার পরে সে যে সম্পূর্ণ শুচি হইয়া ব্ৰাহ্মণ হইবে। তবে সুচরিতা কি চিরদিন অবিবাহিতই থাকিবে ? তাহার উপরে চিরজীবনব্যাপী এই ভার চাপাইবার অধিকার কাহার আছে! স্ত্রীলোকের পক্ষে এতবড়ো ভার আর কী হইতে পারে! হরিমোহিনী কত কী বকিয়া যাইতে লাগিলেন । গোরার কানে তাহা পৌছিল না । গোরা ভাবিতে লাগিল, “বাবা যে এত করিয়া আমাকে প্ৰায়শ্চিত্ত গ্ৰহণ করিতে নিষেধ করিতেছেন, তাহার সে নিষেধের কি কোনো মূল্য নাই ? আমি আমার যে জীবন কল্পনা করিতেছি। সে হয়তো আমার কল্পনামাত্র, সে আমার স্বাভাবিক নয়। সেই কৃত্রিম বােঝা বহন করিতে গিয়া আমি পঙ্গু হইয়া যাইব । সেই বােঝার নিরন্তর ভারে আমি জীবনের কোনো কাজ সহজে সম্পন্ন করিতে পারিব না | এই-যে দেখিতেছি আকাঙক্ষা হৃদয় জুড়িয়া রহিয়াছে। এ পাথর নড়াইয়া রাখিব কোনখানে ! বাবা কেমন করিয়া জানিয়াছেন অন্তরের মধ্যে আমি ব্ৰাহ্মণ নই, আমি তপস্বী নই, সেইজন্যই তিনি এমন জোর করিয়া আমাকে নিষেধ করিয়াছেন ।” গোরা মনে করিল, “যাই তার কাছে । আজ এখনই এই সন্ধ্যাবেলাতেই আমি তাহাকে জোর করিয়া জিজ্ঞাসা করিব তিনি আমার মধ্যে কী দেখিতে পাইয়াছেন । প্ৰায়শ্চিত্তের পথও আমার কাছে রুদ্ধ এমন কথা তিনি কেন বলিলেন ? যদি আমাকে বুঝাইয়া দিতে পারেন তবে সে দিক হইতে ছুটি পাইব— ছুটি ।” হরিমোহিনীকে গোরা কহিল, “আপনি একটুখানি অপেক্ষা করুন, আমি এখনই আসছি।” তাড়াতাড়ি গোরা তাহার পিতার মহলের দিকে গেল। তাহার মনে হইল, কৃষ্ণদয়াল এখনই তাহাকে নিস্কৃতি দিতে পারেন এমন একটা কথা তীহার জানা আছে। সাধনাশ্রমের দ্বার বন্ধ। দুই-এক বার ধাক্কা দিল, খুলিল না- কেহ সাড়াও দিল না । ভিতর হইতে ধূপধুনার গন্ধ আসিতেছে। কৃষ্ণদয়াল আজ সন্ন্যাসীকে লইয়া অত্যন্ত গৃঢ় এবং অত্যন্ত দুরূহ একটি যোগের প্রণালী সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করিয়া অভ্যাস করিতেছেন- আজ সমাপ্ত রাত্রি সে দিকে কাহারও প্ৰবেশ করিবার অধিকার নাই । Գ8 গোরা কহিল- “না। প্ৰায়শ্চিত্ত কাল না। আজই আমার প্রায়শ্চিত্ত আরম্ভ হয়েছে। কালকের চেয়ে ঢের বড়ো আগুন আজ জ্বলছে। আমার নবজীবনের আরম্ভে খুব একটা বড়ো আহুতি আমাকে দিতে হবে বলেই বিধাতা আমার মনে এতবড়ো একটা প্রবল বাসনাকে জাগিয়ে তুলেছেন। নইলে এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কেন ? আমি ছিলুম কোন ক্ষেত্রে! এদের সঙ্গে আমার মেলবার কোনাে লৌকিক সম্ভাবনা ছিল না। আর এমন বিরুদ্ধভাবের মিলনও পৃথিবীতে সচরাচর ঘটে না। আবার সেই মিলনে আমার মতো উদাসীন লোকের চিত্তেও যে এতবড়ো দুৰ্জয় একটা বাসনা জাগতে পারে সে কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না । ঠিক আজই আমার এই বাসনার প্রয়োজন ছিল । আজ পর্যন্ত আমি দেশকে যা দিয়ে এসেছি তা অতি সহজেই দিয়েছি, এমন দান কিছু করতে হয় নি যাতে আমাকে কষ্টবোধ করতে হয়েছে। আমি ভেবেই পেতুম না, লোকে দেশের জন্যে কোনো জিনিস ত্যাগ করতে কিছুমাত্র কৃপণতা বোধ করে কেন । কিন্তু বড়ো যজ্ঞ এমন সহজ দান চায় না। দুঃখই চাই। নাড়ী