পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

どとS রবীন্দ্র-রচনাবলী যেমন রোগীর দিকে তাকাইল তেমনি গোরার দিকেও না তাকাইয়া থাকিতে পারিল না | ভাবিল, এ মানুষটা কে ! তখনো গোরার কপালে গঙ্গামূত্তিকার তিলক ছিল এবং স্নানের পরে সে যে গরদ পরিয়াছিল তাহা পরিয়াই আসিয়াছে। গায়ে জামা নাই, উত্তরায়ের অবকাশ দিয়া তাহার প্রকাণ্ড দেহ দেখা যাইতেছে । পূর্বে হইলে ইংরাজ ডাক্তার দেখিবামাত্র গোরার মনে আপনিই একটা বিদ্বেষ উৎপন্ন হইত। আজ যখন ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করিতেছিল তখন গোরা তাহার প্রতি বিশেষ একটা ঔৎসুক্যের সহিত দৃষ্টিপাত করিল। নিজের মনকে বার বার করিয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “এই লোকটাই কি এখানে আমার সকলের চেয়ে আত্মীয় ? ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া ও প্রশ্ন করিয়া কহিল, “কই, বিশেষ তো কোনো মন্দ লক্ষণ দেখি না । নাড়ীও শঙ্কাজনক নহে এবং শরীর যন্ত্রেরও কোনো বিকৃতি ঘটে নাই। যে উপসর্গ ঘটিয়াছে সাবধান হইলেই তাহার পুনরাবৃত্তি হইবে না।” ডাক্তার বিদায় হইয়া গেলে কিছু না বলিয়া গোরা চৌকি হইতে উঠিবার উপক্ৰম করিল। আনন্দময়ী ডাক্তারের আগমনে পাশের ঘরে চলিয়া গিয়াছিলেন। তিনি দ্রুত আসিয়া গোরার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, “বাবা, গোরা, আমার উপর তুই রাগ করিস নে, তা হলে আমি আর বঁচিব না !” গোরা কহিল, “তুমি এতদিন আমাকে বল নি কেন ? বললে তোমার কোনো ক্ষতি হত না ।” আনন্দময়ী নিজের ঘাড়ে সমস্ত দোষ লাইলেন ; কহিলেন, “বাপ, তোকে পাছে হারাই এই ভয়ে আমি এত পাপ করেছি। শেষে যদি তাই ঘটে, তুই যদি আজ আমাকে ছেড়ে যাস, তা হলে কাউকে দোষ দিতে পারব না, গোরা, কিন্তু সে আমার মৃত্যুদণ্ড হবে যে বাপ !” গোরা শুধু কেবল কহিল, “মা !" গোরার মুখে সেই সম্বোধন শুনিয়া এতক্ষণ পরে আনন্দময়ীর রুদ্ধ অশ্রু উচ্ছসিত হইয়া উঠিল । গোরা কহিল, “মা, এখন আমি একবার পরেশবাবুর বাড়ি যাব ।” আনন্দময়ীর বুকের ভার লাঘব হইয়া গেল। তিনি কহিলেন, “যাও বাবা ।” তাহার আশু মরিবার আশঙ্কা নাই, অথচ গোরার কাছে কথাটা প্রকাশ হইয়া পড়িল, ইহাতে কৃষ্ণদয়াল অত্যন্ত ত্ৰস্ত হইয়া উঠিলেন । কহিলেন, “দেখো গোরা, কথাটা কারও কাছে প্রকাশ করবার তো দরকার দেখি নে। কেবল, তুমি একটু বুঝে-সুঝে বাঁচিয়ে চললেই যেমন চলছিল তেমনি চলে যাবে, কেউ টেরও পাবে না ।” গোরা তাহার কোনো উত্তর না দিয়া বাহির হইয়া গেল। কৃষ্ণদয়ালের সঙ্গে তাহার কোনো সম্বন্ধ নাই ইহা স্মরণ করিয়া সে আরাম পাইল । মহিমের হঠাৎ আপিস কামাই করিবার কোনাে উপায় ছিল না। তিনি ডাক্তার প্রভৃতির সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া দিয়া একবার কেবল সাহেবকে বলিয়া ছুটি লাইতে গিয়াছিলেন। গোরা যেই বাড়ির বাহির হইতেছে এমন সময় মহিম আসিয়া উপস্থিত হইলেন ; কহিলেন, “গোরা, যােচ্ছ কোথায় ?” গোরা কহিল, “ভালো খবর। ডাক্তার এসেছিল। বললে কোনো ভয় নেই।” মহিম অত্যন্ত আরাম পাইয়া কহিলেন, “বাঁচালে। পরশু একটা দিন আছে— শশিমুখীর বিয়ে আমি সেইদিনই দিয়ে দেব। গোরা, তোমাকে কিন্তু একটু উদযোগী হতে হবে। আর দেখো, বিনয়কে কিন্তু আগে থাকতে সাবধান করে দিয়ে— সে যেন সেদিন না এসে পড়ে। অবিনাশ ভারি হিন্দু- সে বিশেষ করে বলে দিয়েছে তার বিয়েতে যেন ওরকম লোক না আসতে পায় । আর-একটি কথা তোমাকে বলে রাখি ভাই, সেদিন আমার আপিসের বড়ো সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে আনব, তুমি যেন তাদের তেড়ে মারতে যেয়ে না। আর কিছু নয়, কেবল একটুখানি ঘাড়টা নেড়ে ‘গুড ইভনিং স্যর বললে তোমাদের হিন্দু শাস্ত্র অসিদ্ধ হয়ে যাবে না- বরঞ্চ পণ্ডিতদের কাছে বিধান নিয়ো । বুঝেছ ভাই, ওরা রাজার জাত, ওখানে তোমার অহংকার একটু খাটাে করলে তাতে অপমান হবে না।” মহিমের কথার কোনো উত্তর না করিয়া গোরা চলিয়া গেল ।