পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ VʻAs বঁচিলাম। আমি ভাবিতেছিলাম চারি দিকে পরিচিতের বেড়ার মধ্যে প্রাত্যহিক নিয়মের দ্বারা আমি বাধা, আজ দেখিতেছি মহা-অপূর্বের কোলের মধ্যে চিরদিন আমি খেলা করিতেছি। আমি ভাবিতেছিলাম আপিসের বড়ো-সাহেবের মতো অত্যন্ত একজন সুগাষ্ঠীর হিসাবি লোকের হাতে পড়িয়া সংসারে প্রত্যহ আঁক পাড়িয়া যাইতেছি, আজ সেই বড়ো-সাহেবের চেয়ে যিনি বড়ো সেই মন্ত বেহিসাবি পাগলের বিপুল উদার অট্টহাস্য জলে স্থলে আকাশে সপ্তলোক ভেদ করিয়া ধ্বনিত শুনিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বীচিলাম। আমার খাতপত্র সমস্ত রহিল। আমার জরুরি কাজের বােঝা ঐ সৃষ্টিছাড়ার পায়ের কাছে ফেলিয়া দিলাম— তাহার তাণ্ডবনৃত্যের আঘাতে তাহা চূৰ্ণচূর্ণ হইয়া ধূলি হইয়া উড়িয়া যাক । δης Σ. Ο রঙ্গমঞ্চ ভারতের নাট্যশাস্ত্ৰে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোনো উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ আমি বোধ করি না। কলাবিদ্যা যেখানে একেশ্বরী সেইখনেই তাহার পূর্ণ গৌরব। সতিনের সঙ্গে ঘর করিতে গেলে তাহাকে খাটাে হইতেই হইবে। বিশেষত সতিন যদি প্রবল হয়। রামায়ণকে যদি সুর করিয়া পড়িতে হয় তবে আদিকাণ্ড হইতে উত্তরকাণ্ড পর্যন্ত সে সুরকে চিরকাল সমান একঘেয়ে হইয়া থাকিতে হয়, রাগিণী-হিসাবে সে বেচারার কোনােকালে পদােন্নতি ঘটে না। যাহা উচ্চাদরের কাব্য তাহা আপনার সংগীত আপনার নিয়মেই জোগাইয়া থাকে, বাহিরের সংগীতের সাহায্য অবজ্ঞার সঙ্গে উপেক্ষা করে। যাহা উচ্চ-অঙ্গের সংগীত তাহা আপনার কথা আপনার নিয়মেই বলে, তাহা কথার জন্য কালিদাস-মিলটনের মুখাপেক্ষা করে না— তাহা নিতান্ত তুচ্ছ তোম-তানা-নানা লইয়াই চমৎকার কাজ চালাইয়া দেয় । ছবিতে গানেতে কথায় মিশাইয়া ললিতকলার একটা বারোয়ারি ব্যাপার করা যাইতে পারে, কিন্তু সে কতকটা খেলা-হিসাবে ; তাহা হাটের জিনিস, তাহাকে রাজকীয় উৎসবের উচ্চ আসন দেওয়া যাইতে পারে না | কিন্তু শ্ৰাব্যাকাব্যের চেয়ে দৃশ্যকাব্য স্বভাবতই কতকটা পরাধীন বটে। বাহিরের সাহায্যেই নিজেকে সার্থক করিবার জন্য সে বিশেষভাবে সৃষ্ট। সে যে অভিনয়ের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে, এ কথা তাহাকে স্বীকার করিতেই হয় । আমরা এ কথা স্বীকার করি না। সাধবী স্ত্রী যেমন স্বামীকে ছাড়া আর-কাহাকেও চায় না, ভালো কাব্য তেমনি ভাবুক ছাড়া আর-কাহারও অপেক্ষা করে না। সাহিত্য পাঠ করিবার সময় আমরা সকলেই মনে মনে অভিনয় করিয়া থাকি ; সে অভিনয়ে যে কাব্যের সৌন্দর্য খোলে না। সে কাব্য কোনো কবিকে যশস্বী করে নাই | বরঞ্চ এ কথা বলিতে পারো যে, অভিনয় বিদ্যা নিতান্ত পরাশ্ৰিতা । সে অনাথ নাটকের জন্য পথ চাহিয়া বসিয়া থাকে। নাটকের গৌরব অবলম্বন করিয়াই সে আপনার গীেরব দেখাইতে পারে। স্ত্ৰৈণ স্বামী যেমন লােকের কাছে উপহাস পায়, নাটক তেমনি যদি অভিনয়ের অপেক্ষা করিয়া আপনাকে নানা দিকে খর্ব করে তবে সে-ও সেইরূপ উপহাসের যোগ্য হইয়া উঠে। নাটকের ভাবখানা এইরূপ হওয়া উচিত যে, “আমার যদি অভিনয় হয় তো হউক, না হয় তো অভিনয়ের পোড়াকপালআমার কোনোই ক্ষতি নাই।’ যাহাই হউক, অভিনয়কে কাব্যের অধীনতা স্বীকার করিতেই হয়। কিন্তু তাই বলিয়া সকল কলাবিদ্যারই গোলামি তাহাকে করিতে হইবে এমন কী কথা আছে। যদি সে আপনার গৌরব রাখিতে চায় তবে যেটুকু অধীনতা তাহার আত্মপ্রকাশের জন্য নিতান্তই না হইলে নয়। সেইটুকুই সে যেন গ্ৰহণ