পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্ৰ প্ৰবন্ধ \ኃbr\© যথাযথারূপে মিশ্রিত হইয়া ছন্দকে যে দােলা দিয়াছে, তাহা জয়দেবী লয়ের মতো অতিপ্রত্যক্ষ নহে; তাহা নিগৃঢ় ; মন তাহা আলস্যভরে পড়িয়া পায় না, নিজে আবিষ্কার করিয়া লইয়া খুশি হয়। এই শ্লোকের মধ্যে যে-একটি ভাবের সৌন্দর্য তাহাও আমাদের মনের সহিত চক্রান্ত করিয়া অশ্রুতিগম্য একটি সংগীত রচনা করে, সে সংগীত সমস্ত শব্দসংগীতকে ছাড়াইয়া চলিয়া যায় ; মনে হয়, যেন কান জুড়াইয়া গেলা— কিন্তু কান জুড়াইবার কথা নহে, মানসী মায়ায় কানকে প্রতারিত করে। আমাদের এই মায়াবী মনটিকে সৃজনের অবকাশ না দিলে, সে কোনো মিষ্টতাকেই বেশিক্ষণ মিষ্ট । বলিয়া গণ্য করে না । সে উপযুক্ত উপকরণ পাইলে কঠোর ছন্দকে ললিত, কঠিন শব্দকে কোমল করিয়া তুলিতে পারে। সেই শক্তি খাটাইবার জন্য সে কবিদের কাছে অনুরোধ প্রেরণ করিতেছে। কেকারব কানে শুনিতে মিষ্ট নহে, কিন্তু অবস্থাবিশেষে সময়বিশেষে মন তাহাকে মিষ্ট করিয়া শুনিতে পারে, মনের সেই ক্ষমতা আছে। সেই মিষ্টতার স্বরূপ, কুহুতানের মিষ্টতা হইতে স্বতন্ত্র। নববর্ষাগমে গিরিপাদমূলে লতাজটিল প্রাচীন মহারণ্যের মধ্যে যে মত্তত উপস্থিত হয় কেকারব | তাহারই গান। আষাঢ়ে শ্যামায়মান তমালতালীবনের দ্বিগুণতর ঘনায়িত অন্ধকারে, মাতৃস্তন্যপিপাসু উধৰ্ব্ববাহু শতসহস্র শিশুর মতো অগণ্য শাখাপ্রশাখার আন্দােলিত মর্মরমুখর মহােল্লাসের মধ্যে, রহিয়া-রহিয়া কেকা তারস্বরে যে একটি কাংস্যক্ৰেংকারধ্বনি উত্থিত করে তাঁহাতে প্ৰবীণ বনস্পতিমণ্ডলীর মধ্যে আরণ্য মহােৎসবের প্রাণ জাগিয়া উঠে । কবির কেকারব সেই বর্ষার গান ; কান তাহার মাধুর্য জানে না, মনই জানে। সেইজন্য মন তাহাতে অধিক মুগ্ধ হয় । মন তাহার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেকখানি পায়— সমস্ত মেঘাবৃত আকাশ, ছায়াবৃত অরণ্য, নীলিমাচ্ছন্ন গিরিশিখর, বিপুল মূঢ় প্রকৃতির অব্যক্ত অন্ধ আনন্দরাশি । বিরাহিণীর বিরহবেদনার সঙ্গে কবির কেকারব। এইজন্যই জড়িত। তাহা শ্রুতিমধুর বলিয়া পথিকবধূকে ব্যাকুল করে না, তাহা সমস্ত বর্ষার মৰ্মোদঘাটন করিয়া দেয়। নরনারীর প্রেমের মধ্যে একটি অত্যন্ত আদিম প্রাথমিক ভােব আছে ; তাহা বহিঃপ্রকৃতির অত্যন্ত নিকটবতী, তাহা জলস্থল-আকাশের গায়ে গায়ে সংলগ্ন। ষড় ঋতু আপন পুষ্পপর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রেমকে নানা রঙে রাঙাইয়া দিয়া যায়। যাহাতে পল্লবকে স্পন্দিত, নদীকে তরঙ্গিত, শস্যশীর্ষকে হিল্লোলিত করে, তাহা ইহাকেও অপূর্ব চাঞ্চলে আন্দােলিত করিতে থাকে। পূর্ণিমার কোটাল ইহাকে স্ফীত করে এবং সন্ধ্যাভ্রের রক্তিময় ইহাকে লজ্জামণ্ডিত বধূবেশ পরাইয়া দেয়। এক-একটি ঋতু যখন আপন সোনার কাঠি লইয়া প্রেমকে স্পর্শ করে, তখন সে রোমাঞ্চকলেবারে না জাগিয়া থাকিতে পারে না । সে অরণ্যের পুষ্পপল্লবেরই মতো প্রকৃতির নিগৃঢ়স্পর্শধীন। সেইজন্য যৌবনাবেশবিধুর কালিদাস ছয় ঋতুর ছয় তারে নরনারীর প্রেম কী কী সুরে বাজিতে থাকে তাহাই বৰ্ণনা করিয়াছেন ; তিনি বুঝিয়াছেন জগতে ঋতু-আবর্তনের সর্বপ্রধান কাজ প্ৰেম-জাগানো, ফুল-ফুটানো প্রভৃতি অন্য সমস্তই তাহার আনুষঙ্গিক। তাই যে কেকারব বৰ্ষাঋতুর নিখাদ সুর তাহার আঘাত বিরহবেদনার ঠিক উপরে গিয়াই পড়ে | বিদ্যাপতি লিখিয়াছেন মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী ফাটি যাওত ছাতিয়া । এই ব্যাঙের ডাক নববর্ষার মত্তভাবের সঙ্গে নহে, ঘন বর্ষার নিবিড় ভাবের সঙ্গে বড়ো চমৎকার খাপ খায় । মেঘের মধ্যে আজ কোনো বর্ণবৈচিত্ৰ্য নাই, স্তরবিন্যাস নাই ; শচীর কোনো প্রাচীন কিংকরী আকাশের প্রাঙ্গণ মেঘ দিয়া সমান করিয়া লেপিয়া দিয়াছে, সমস্তই কৃষ্ণধূসরবর্ণ। নানাশস্যবিচিত্রা পৃথিবীর উপরে উজ্জ্বল আলোকের তুলিকা পড়ে নাই বলিয়া বৈচিত্র্য ফুটিয়া ওঠে নাই | ধানের কোমল মসৃণ সবুজ, পাটের গাঢ় বৰ্ণ এবং ইক্ষুর হরিদ্রাভা একটি বিশ্বব্যাপী-কালিময় মিশিয়া আছে। বাতাস নাই। আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় পঙ্কিল পথে লোক বাহির হয় নাই। মাঠে বহুদিন পূর্বে খেতের কাজ সমস্ত শেষ হইয়া গেছে । পুকুরে পাড়ির সমান জল। এইরূপ জ্যোতিহীন, V88