পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

লোকসাহিত্য ዓ (፩ S পাঠ করা যায়, পুরাকালে কোনো কোনো মহাত্মা ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষমতা লাভ করিয়াছিলেন। আমার মনের ইচ্ছান্ধত ইচ্ছাবধিরতার শক্তি আছে এবং এই শক্তি তাহাকে প্রতিপদে ব্যবহার করিতে হয় বলিয়া জন্ম হইতে মৃত্যুকাল পর্যন্ত জগতের অধিকাংশই তাহার চেতনার বহির্ভাগ দিয়া চলিয়া যায়। সে নিজে বিশেষ উদযোগী হইয়া যাহা গ্রহণ করে এবং নিজের আবশ্যক ও প্রকৃতি -অনুসারে গঠিত করিয়া লয় তাহাই সে উপলব্ধি করে ; চতুর্দিকে, এমন-কি মানসপ্রদেশেও, যাহা ঘটিতেছে, যাহা উঠিতেছে, তাহার সে ভালোরূপ খোজ’ রাখে না । সহজ অবস্থায় আমাদের মনসাকাশে স্বপ্নের মতো যে-সকল ছায়া এবং শব্দ যেন কোন অলক্ষ্য বায়ুপ্রভাবে দৈবচালিত হইয়া কখনাে সংলগ্ন কখনাে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিচিত্র আকার ও বর্ণ নিজের প্রতিবিম্বপ্রবাহ চিহ্নিত করিয়া যাইতে পারিত তবে তাহার সহিত আমাদের আলোচ্য এই ছড়াগুলির অনেক সাদৃশ্য দেখিতে পাইতাম। এই ছড়াগুলি আমাদের নিয়তপরিবর্তিত অন্তরাকাশের ছায়ামাত্র, তরল স্বচ্ছ সরোবরের উপর মেঘক্রীড়িত নভোমণ্ডলের ছায়ার মতো । সেইজন্যই বলিয়ছিলাম ইহারা আপনি জন্মিয়াছে। উদাহরণস্বরূপে এইখানে দুই-একটি ছড়া উদধূত করিবার পূর্বে পাঠকদের নিকট মার্জনা ভিক্ষা করি। প্রথমত, এই ছড়াগুলির সঙ্গে চিরকাল যে স্নেহদ্র সরল মধুর কণ্ঠ ধ্বনিত হইয়া আসিয়াছে আমার মতো মর্যাদাভীরু গভীরস্বভাব বয়স্ক পুরুষের লেখনী হইতে সে ধ্বনি কেমন করিয়া ক্ষরিত হইবে। পাঠকগণ আপন গৃহ হইতে, আপনি বাল্যস্মৃতি হইতে, সেই সুধাম্নিগ্ধ সুরটুকু মনে মনে সংগ্ৰহ করিয়া লইবেন । ইহার সহিত যে মেহটি, যে সংগীতটি, যে সন্ধ্যাপ্ৰদীপালোকিত সৌন্দর্যচ্ছবিটি চিরদিন একাত্মভাবে মিশ্রিত হইয়া আছে সে আমি কোন মোহমন্ত্রে পাঠকদের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিব ! ভরসা করি, এই ছড়াগুলির মধ্যে সেই মোহমন্ত্রটি আছে। দ্বিতীয়ত, আটঘাট-বাধা রীতিমত সাধুভাষার প্রবন্ধের মাঝখানে এই সমস্ত গৃহচারিণী অকৃতবেশ অসংস্কৃতা মেয়েলি ছড়াগুলিকে দাঁড় করাইয়া দিলে তাহাদের প্রতি কিছু অত্যাচার করা হয়— যেন আদালতের সাক্ষ্যমঞ্চে ঘরের বধূকে উপস্থিত করিয়া জেরা করা। কিন্তু উপায় নাই। আদালতের নিয়মে আদালতের কাজ হয়, প্রবন্ধের নিয়মানুসারে প্রবন্ধ রচনা করিতে হয় ; নিষ্ঠুরতাটুকু অপরিহার্য- 瞻 যমুনাবতী সরস্বতী, কাল যমুনার বিয়ে। যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে ৷ কাজিফুল কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা । হাত-কুম-কুম পা-ঝুমঝুম সীতারামের খেলা ৷ নাচো তো সীতারাম কঁকাল বেঁকিয়ে । আলোচাল দেব টাপাল ভরিয়ে ৷ আলোচাল খেতে খেতে গলা হল কাঠ । হেথায় তো জল নেই, ত্রিপূর্ণির ঘাট ৷ ऊ বােনকে বিয়ে করি ওড়াফুল দিয়ে ॥ ওড়ফুল কুড়োতে হয়ে গেল বেলা । তার বোনকে বিয়ে করি ঠিক-দুক্ষর বেলা ৷ ইহার মধ্যে ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ নাই সে কথা নিতান্তই পক্ষপাতী সমালোচককেও স্বীকার করিতে হইবে। কতকগুলি অসংলগ্ন ছবি নিতান্ত সামান্য প্রসঙ্গসূত্র অবলম্বন করিয়া উপস্থিত ইয়াছে। একটা এই দেখা যাইতেছে, কোনােপ্রকার বাছ-বিচার নাই। যেন কবিত্বের সিংহদ্বারে নিস্তব্ধ