পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WS)08 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিশ্বাস আমাদের গায়ের উপরে আসিয়া পড়ে, এবং নিত্যজাগ্রত নিখিলজননীর অনিমেষদৃষ্টি আমাদের শিয়রের কাছে প্রত্যক্ষগম্য হইয় উঠে। আমাদের রজনীর উংসব সেই নিভৃতনিগুঢ় অথচ বিশ্বব্যাপী জননীকক্ষের উৎসব। এখন আমরা কাজের কথা ভুলি, সংগ্রামের কথা ভূলি, আত্মশক্তি-অভিমানের চর্চা তুলি, আমরা সকলে মিলিয়া তাহার প্রসন্ন মুখচ্ছবির ভিখারি হইয়া দাড়াই—বলি, জননী, ষখন প্রয়োজন ছিল, তখন তোমার কাছে ক্ষুধার অন্ন, কর্মের শক্তি, পথের পাথেয় প্রার্থনা করিয়াছিলাম–কিন্তু এখন সমস্ত প্রয়োজনকে বাহিরে ফেলিয়া আসিয়া তোমার এই কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছি, এখন একান্ত তোমাকেই প্রার্থনা করি । আমি তোমার কাছে এখন আর হাত পাতিব না—কেবলমাত্র তুমি আমাকে স্পর্শ করে, মার্জন করে, গ্রহণ করো। তোমার রজনী-মহাসমুদ্রে অবগাহন-স্নান করিয়া বিশ্বজগৎ যখন কাল উজ্জলবেশে নির্মলললাটে প্রভাত-আলোকে দণ্ডায়মান হইবে, তখন যেন আমি তাহার সঙ্গে e সমান হইয়া দাড়াইতে পারি—তখন যেন আমার গ্লানি না থাকে, আমার ক্লাস্তি দূর হয়— তখন যেন আমি অস্তরের সহিত বলিতে পারি—সকলের কল্যাণ হউক, কল্যাণ হউক, যেন বলিতে পারি—সকলের মধ্যে যিনি আছেন, র্তাহাকে আমি দেখিতেছি,—র্তাহার যাহা প্রসাদ, তিনি অদ্য সমস্তদিন আমাকে যাহা দিবেন, তাহাই আমি ভোগ করিব, আমি কিছুতেই লোভ করিব না । প্রাতঃকালে যিনি আমাদের পিতা হইয়া আমাদিগকে কৰ্মশালায় প্রেরণ । করিয়াছিলেন, সন্ধ্যাকালে তিনিই আমাদের মাত হইয়া আমাদিগকে র্তাহার অন্তঃপুরে আকর্ষণ করিয়া লইতেছেন। প্রাতঃকালে তিনি আমাদিগকে ভার দিয়াছিলেন, সন্ধ্যাকালে তিনি আমাদের ভার লইতেছেন। প্রত্যহই দিনে-রাত্রে এই যে দুই বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে আমাদের জীবন আন্দোলিত হইতেছে—একবার পিতা আমাদিগকে বহির্দেশে পাঠাইতেছেন, একবার মাতা আমাদিগকে অন্তঃপুরে টানিতেছেন, একবার নিজের দিকে ধাবিত হইতেছি, একবার অধিলের দিকে প্রত্যাবর্তন করিতেছি, ইহার মধ্যে আমাদের জীবন ও মৃত্যুর গভীর রহস্তচ্ছবি আলোক-অন্ধকারের তুলিকাপাতে প্রতিদিন বিচিত্র হইতেছে। আমাদের কাব্যে-গানে আয়ু-অবসানের সহিত আমরা দিনাস্তের উপমা দিয়া থাকি—কিন্তু সকল সময়ে তাহার সম্পূর্ণ ভাবটি আমরা হৃদয়ংগম করি না, আমরা কেবল অবসানেরই দিকটা দেখিয়া বিষাদের নিঃশ্বাস কেলি, পরিপূরণের দিকটা দেখি না। আমরা ইহা ভাবিয়া দেখি না, প্রত্যহ দিবাবসানে এত বড়ে যে একটা বিপরীত ব্যাপার ঘটতেছে, আমাদের শক্তির যে এমন-একটা বিপর্যয়দশ উপস্থিত হইতেছে, তাহাতে