পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বাপরিচয় @ՀԳ যে-আলোর সাহায্যে দেহের চামড়ার ঢাকা পেরিয়ে ভিতরকার হাড় দেখতে পাওয়া যায় । আলো জিনিসটাতে কেবল যে নক্ষত্রের অস্তিত্বের খবর দেয় তা নয়, ওদের মধ্যে কোন কোন পদার্থ মিলিয়ে আছে, মানুষ সে খবরও আলোর যেন বুক চিরে আদায় করে নিয়েছে। কেমন করে আদায় হল বুঝিয়ে বলা যাক । তিনপিঠওয়ালা কাচের ভিতর দিয়ে সূর্যের সাদা আলো পার করলে তার সাতটা রঙের পরিচয় পরে পরে বেরিয়ে পড়ে। লোহা প্রভৃতি শক্ত জিনিস যথেষ্ট তেন্তে জ্বলে উঠলে তার আলো যখন ক্ৰমে সাদা হয়ে ওঠে তখন এই সাদা আলো ভাগ করলে সাত রঙের ছটা পাশাপাশি দেখা যায়। তাদের মাঝে মাঝে কোনো ফাক থাকে না। কিন্তু লোহকে গরম করতে করতে যখন তা গ্যাস হয়ে যায়। তখন ঐ কঁচের ভিতর দিয়ে তার আলো ভাঙলে বর্ণজটায় একটানা আলো পাই নে । দেখা যায় আলাদা আলাদা উজ্জ্বল রেখা, তাদের মধ্যে মধ্যে থাকে আলোহীন ফাঁকা জায়গা। এই বর্ণালোকচিহ্নপাতের নাম দেওয়া যাক বর্ণলিপি । এই লিপিতে দেখা গেছে দীপ্ত গ্যাসীয় অবস্থায় প্রত্যেক জিনিসের আলোর বর্ণচ্ছটা স্বতন্ত্র । নুনের মধ্যে সোডিয়ম-নামক এক মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায় । তাপ দিয়ে দিয়ে তাকে গ্যাস করে ফেললে বর্ণলিপিতে তার আলোর মধ্যে খুব কাছাকাছি দেখা যায় দুটি হলদে রেখা। আর-কোনো রঙ পাই নে। সোডিয়ম ছাড়া অন্য কোনো জিনিসেরই বর্ণচ্ছটায় ঠিক ঐ জায়গাতেই ঐ দুটি রেখা মেলে না। ঐ দুটি রেখা যেখানকারই গ্যাসের বর্ণলিপিতে দেখা যাবে বুঝব সেখানে সোডিয়ম আছেই। কিন্তু দেখা যায় সূর্যের আলোর বর্ণচ্ছটায় সোডিয়ম গ্যাসের ঐ দুটি উজ্জ্বল হলদে রেখা চুরি গেছে, তার জায়গায় রয়েছে দুটাে কালো দাগ। বিজ্ঞানী বলেন উত্তপ্ত কোনো গ্যাসীয় জিনিসের আলো সেই গ্যাসেরই অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা স্তরের ভিতর দিয়ে আসার সময় সম্পূর্ণ শোষিত হয়। এ ক্ষেত্রে আলোর অভাবেই যে কালো দাগের সৃষ্টি তা নয়। বস্তুত সূর্যের বর্ণমণ্ডলে যে সোডিয়ম গ্যাস সূর্যের আলো আটক করে সেও আপনি উত্তাপ অনুযায়ী আলো ছড়িয়ে দেয়, আলোকমণ্ডলের তুলনায় উত্তাপ কম বলে এর আলো হয় অনেকটা স্নান । এই স্নান আলো বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল আলোর পাশে কালোর বিভ্রম জন্মায় । মৌলিক জিনিস মাত্রেরই আলো ভেঙে প্ৰত্যেকটির বর্ণচ্ছটার ফর্দ তৈরি হয়ে গেছে । এই বৰ্ণভেদের সঙ্গে তুলনা করলেই বস্তুভেদ ধরা পড়বে, তা সে যেখানেই থােক, কেবল গ্যাসীয় অবস্থায় शांकों bारै । পৃথিবী থেকে যে বিরোনব্বইটি মৌলিক পদার্থের খবর পাওয়া গেছে সূর্যে তার সবগুলিরই থাকা উচিত ; কেননা, পৃথিবী সূর্যেরই দেহজাত। প্রথম পরীক্ষায় পাওয়া গিয়েছিল ছত্রিশটি মাত্র জিনিস। বাকিগুলির কী হল।সেই প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। নূতন সন্ধানপথ বের করে সূর্যে আরো কতকগুলি মৌলিক জিনিস তিনি ধরতে পেরেছেন। তার পথ বেয়ে প্রায় সবগুলিরই খবর মিলেছে। আজও যেগুলি গারাঠিকানা মাঝপথেই পৃথিবীর হাওয়া তাদের সংবাদ শুযে tr | সব রঙ মিলে সূর্যের আলো সাদা, তবে কেন নানা জিনিসের নানা রঙ দেখি। তার কারণ সব জিনিস সব রঙ নিজের মধ্যে নেয় না, কোনো কোনোটাকে বিনা ওজরে বাইরে বিদায় করে দেয় । সেই ফেরত-দেওয়া রঙটাই আমাদের চোখের লাভ । মোট ব্লটিং যে রাসটা শুৰে ফেলে সে কারও ভোগে লাগে না, যে রাসটা সে নেয় না। সেই উদূৰ্ববৃত্ত রসটাই আমাদের পাওনা। এও তেমনি । চুনি পাথর সূৰ্যীকরণের আর-সবরকম ঢেউকেই মেনে নেয়, ফিরিয়ে দেয় লাল রঙকে । তার এই ত্যাগের দানেই চুনির খ্যাতি । যা নিজে আত্মসাৎ করেছে তার কোনো খ্যাতি সেই । লাল রঙটাই কেন যে ও নেয় না। আর নীল রঙের 'পরেই নীলা পাথরের কেন সম্পূৰ্ণ বৈরাগ্য এ প্রশ্নের জবাব ওদের পরমাণু মহলে লুকানো রইল। সূর্যের সব ঢেউকেই পাকা-চুল ফিরে পাঠায় তাই সে সাদা, কঁচা-চুল কোনো ঢেউই ফিরে দেয় না, অর্থাৎ আলোর কোনো অংশই তার কাছ থেকে ছাড়া পায় না, তাই সে কালো ।