পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেলা ዓ $6: জানিয়ে রাখি আমাদের চাল ছিল গরিবের মতো । গাড়িঘোড়ার বালাই ছিল না বললেই হয় । বাইরে কোণের দিকে তেঁতুল গাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটা পালকিগাড়ি আর একটা বুড়ো ঘোড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে । যখন ব্ৰজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানে বরাদ্দ হল পাউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন, মনে হল আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল। সাবেক কালের বড়োমানুষের ভগ্নদশা সহজেই মেনে নেবার তালিম চলছিল । আমাদের এই মাদূর-পাতা আসরে যে চাকরিটি ছিল সর্দার তার নাম ব্ৰজেশ্বর । চুলে গোফে লোকটা কঁাচাপাকা, মুখের উপর টানপড়া শুকনো চামড়া, গভীর মেজাজ, কড়া গলা, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা । তার পূর্ব মনিব ছিলেন লক্ষ্মীমন্ত, নামডাকওয়ালা। সেখান থেকে তাকে নাবিতে হয়েছে। আমাদের মতো হেলায়-মানুষ ছেলেদের খবরদারির কাজে । শুনেছি। গ্রামের পাঠশালায় সে গুরুগিরি করেছে। এই গুরুমশায়ি ভাষা আর চাল ছিল তার শেষ পর্যন্ত । বাবুরা বসে আছেন না বলে সে বলত ‘অপেক্ষা করে আছেন । শুনে মনিবরা হাসাহসি করতেন । যেমন ছিল তার গুমোর তেমনি ছিল তার শুচিবাই । স্নানের সময় সে পুকুরে নেমে উপরকার তেলভাসা জল দুই হাত দিয়ে পাঁচ-সাতবার ঠেলে দিয়ে একেবারে ঝুপ করে দিত ডুব । স্নানের পর পুকুর থেকে উঠে বাগানের রাস্তা দিয়ে ব্ৰজেশ্বর এমন ভঙ্গিতে হাত বঁকিয়ে চলত যেন কোনোমতে বিধাতার এই নোংরা পৃথিবীটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই তার জাত বঁাচে । চাল চলনে কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়, এ নিয়ে খুব ঝোক দিয়ে সে কথা কইত। এ দিকে তার ঘাড়টা ছিল কিছু বাকা, তাতে তার কথার মান বাড়তি । কিন্তু ওরই মধ্যে একটা খুঁত ছিল গুরুগিরিতে। ভিতরে ভিতরে তার আহারের লোভটা ছিল চাপা । আমাদের পাতে আগে থাকতে ঠিকমত ভাগে খাবার সাজিয়ে রাখা তার নিয়ম ছিল না। আমরা খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি, আলগােছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ‘আর দেব কি। কোন উত্তর তার মনের মতো সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে । আমি প্রায়ই বলতুম, চাই নে।” তার পরে আর সে পীড়াপীড়ি করত না । দুধের বাটিটার পরেও তার অসামাল রকমের টান ছিল, আমার মোটে ছিল না । শেলফওয়ালা একটা খাটাে আলমারি ছিল তার ঘরে । তার মধ্যে একটা বড়ো পিতলের বাটিতে থাকত দুধ, আর কাঠের বারকোশে লুচি তরকারি । বিড়ালের লোভ জালের বাইরে বাতাস। তঁকে শুকে KUNe এমনি করে অল্প খাওয়া আমার ছেলেবেলা থেকেই দিব্যি সয়ে গিয়েছিল। সেই কম খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল এমন কথা বলবার জো নেই। যে ছেলেরা খেতে কসুর করত না তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি বৈ কম ছিল না। শরীর এত বিশ্ৰী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোক যখন হয়রান করে দিত। তখনো শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সন্দি হল না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি, চুল জামা গেছে ভিজে, গলার মধ্যে একটু খুসন্ধুসুনি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায় নি। আর পেট-কামড়ানি বলে ভিতরে ভিতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাই নি পেটে, কেবল দরকার মত মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয় নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, “আচ্ছা যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না ।” আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন, ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কি লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হত, তার উপরে খেতে হত। কানীমলা। হয়তো বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন। ক্যাস্টর অয়েল। চিরকালের জন্যে আরাম হত ব্যামোটা । দৈবাৎ কখনো আমার জ্বর হয়েছে ; তাকে কেউ জ্বর বলত না, বলত গা-গরম। আসতেন নীলমাধব ডাক্তার। থার্মেমিটার তখন চক্ষেও দেখি নি; ডাক্তার একটু গায়ে হাত দিয়েই প্রথমদিনের ব্যবস্থা করতেন ক্যাস্টর অয়েল আর উপোস। জল খেতে পেতুম অল্প একটু, সেও গরম জল । তার সঙ্গে এলাচদানা চলতে পারত । তিন দিনের দিনই মীেরালা মাছের ঝোল আর SO 8V