পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেলা Se দেউড়িতে বাজত সাতটা । নীলকমল-মাস্টারের ঘড়ি-ধরা সময় ছিল নিরেট । এক মিনিটের তফাত হবার জো ছিল না। খট্রখটে রোগা শরীর, কিন্তু স্বাস্থ্য তার ছাত্রেরই মতে, এক দিনের জন্যেও মাথাধরার সুযোগ ঘটল না। বইনিয়ে গ্রেট নিয়ে যৌতুম টেবিলের সামনে । কালো বোর্ডের উপর খড়ি দিয়ে অঙ্কের দাগ পড়তে থাকত- সবই বাংলায়, পাটীগণিত, বীজগণিত, রেখাগণিত। সাহিত্যে ‘সীতার বনবাস থেকে একদম চড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘মেঘনাদবধ কাব্যে । সঙ্গে ছিল প্রাকৃতবিজ্ঞান। মাঝে মাঝে আসতেন সীতানাথ দত্তই বিজ্ঞানের ভাসা ভাসা খবর পাওয়া যেত জানা জিনিস পরখ করে। মাঝে একবার এলেন হেরম্ব তত্ত্বরত্ন ! লাগলুম কিছু না বুঝে মুগ্ধবোধ মুখস্থ করে ফেলতে । এমনি করে সারা সকাল জুড়ে নানারকম পড়ার যতই চাপ পড়ে মন ততই ভিতরে ভিতরে চুরি করে কিছু কিছু বোঝা সরাতে থাকে, জালের মধ্যে ফাক করে তার ভিতর দিয়ে মুখস্থ বিদ্যে ফসকিয়ে যেতে চায়, আর নীলকমল মাস্টার ষ্ঠার ছাত্রের বুদ্ধি নিয়ে যে মত জারি করতে থাকেন তা বাইরের পাঁচজনকে ডেকে ডেকে শোনাবার মতো হয় না । বারান্দায় আর-এক ধারে বুড়ো দরজি, চোখে আতশী কাচের চশমা, ঝুঁকে পড়ে কাপড় সেলাই করছে, মাঝে মাঝে সময় হলে নমাজ পড়ে নিচ্ছে- চেয়ে দেখি আর ভাবি কী সুখেই আছে নেয়ামত । অঙ্ক কষতে মাথা যখন ঘুলিয়ে যায় চোখের উপর স্লেট আড়াল করে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, দেউড়ির সামনে চন্দ্রভান, লম্বা দাড়ি কাঠের কঁকাই দিয়ে আঁচড়িয়ে তুলছে দুই কানের উপর দুই ভাগে। পাশে বসে আছে কাকন-পরা ছিপছিপে ছোকরা দরোয়ান, কুটছে তামাক । ঐখানে ঘোড়াটা সকালেই খেয়ে গেছে। বালতিতে বরাদ্দ দানা, কাকগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে ঠোকরাচ্ছে ছিটিয়েপড়া ছোলা, জনি কুকুরটার কর্তব্যবোধ জেগে ওঠে- ঘেউ ঘেউ করে দেয় তাড়া । বারান্দায় এক কোণে বঁট দিয়ে জমা করা ধুলোর মধ্যে পুতেছিলুম আতার বিচি” । কবে তার থেকে কচি পাতা বেরবে দেখবার জন্যে মন ছটফট করছে। নীলকমল মাস্টার উঠে গেলেই ছুটে গিয়ে তাকে দেখে আসা চাই, আর দেওয়া চাই জল । শেষ পর্যন্ত আমার আশা মেটে নি । যে বঁটা একদিন সূৰ্য উপরে উঠে যায়, অর্ধেক আঙিনায় হেলে পড়ে ছায়া। নটা বাজে। বেঁটে কালো গোবিন্দ কঁধে হলদে রঙের ময়লা গামছা বুলিয়ে আমাকে নিয়ে যায় স্নান করাতে । সাড়ে নটা বাজাতেই রোজকার বরাদ্দ ডাল ভাত মাছের ঝোলের বাধা ভোজ । রুচি হয় না খেতে । ঘণ্টা বাজে দশটার । বড়ো রাস্তা থেকে মন-উদাসী-করা ডাক শোনা যায়। কঁচা-আম-ওয়ালার । , বাসনওয়ালা ঠং ঠং আওয়াজ দিয়ে চলছে দূরের থেকে দূরে । গলির ধারের বাড়ির ছাতে বড়োবউ ভিজে চুল শুকোচ্ছে রোদদূরে, তার দুই মেয়ে কড়ি নিয়ে খেলেই চলেছে, কোনো তাড়া নেই। মেয়েদের তখন ইস্কুল যাওয়ার তাগিদ ছিল না। মনে হত মেয়ে-জন্মটা নিছক সুখের । বুড়ো ঘোড়া । পালকিগাড়িতে করে টেনে নিয়ে চলল আমার দশটা-চারটার আন্দামানে । সাড়ে চারটের পর ফিরে আসি ইস্কুল থেকে । জিমনাস্টিকের মাস্টার এসেছেন। কাঠের ডাণ্ডার উপর ঘণ্টাখানেক ধরে শরীরটাকে উলটাপালট করি । তিনি যেতে না যেতে এসে পড়েন। ছবি-আঁকার মাস্টার । ক্রমে দিনের মরচে পড়া আলো মিলিয়ে আসে। শহরের পাঁচমিশালি ঝাপসা শব্দে স্বপ্নের সুর লাগায় ইটকাঠের দৈত্যটার দেহে । পড়বার ঘরে জ্বলে ওঠে তেলের বাতি । অঘোর মাস্টার এসে উপস্থিত । শুরু হয়েছে ইংরেজি পড়া। কালো কালো মলাটের রীড়ার যেন ওত পেতে রয়েছে টেবিলের উপর । মলাটটা ঢলঢলে, পাতাগুলো কিছু ছিড়েছে, কিছু দাগী, অজায়গায় হাত পাকিয়েছি নিজের নাম ইংরেজিতে লিখে- তার ১ নীলকমল ঘোষাল- জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তদশ খণ্ড, পৃ. ২৮৪(সুলভ নবম খণ্ড, পৃ. ৪২৪) ২ সীতানাথ ঘোৰ ? ৩ দ্রষ্টব্য “আতার বিচি - ছড়ার ছবি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, (সুলভ একাদশ খণ্ড)