পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী موسواسي তথাপি, অমানুষিক ক্ষমতাবলে সমস্ত কর্তব্য যথাযথ পালন করিলেও সেই অন্তরস্থিত বিদ্বেষ প্রজাকে পীড়ন করিতে থাকে। কারণ, যেমন জলের ধর্ম আপনার সমতল সন্ধান করা তেমনি মানবহৃদয়ের ধর্ম আপনার সম-ঐক্য অন্বেষণ করা। এমন কি, প্রেমের স্বত্রে ঈশ্বরের সহিত সে আপনার ঐক্য স্থাপন করে। যেখানে সে আপনার ঐক্যের পথ খুজিয়া না পায় সেখানে অন্ত যতপ্রকার সুবিধা থাক সে অতিশয় ক্লিষ্ট হইতে থাকে। মুসলমান রাজা অত্যাচারী ছিল কিন্তু তাহদের সহিত আমাদের অনেক বিষয়ে সমকক্ষতার সাম্য ছিল । আমাদের দর্শন কাব্য আমাদের কলাবিদ্যা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিতে রাজায় প্রজায় আদানপ্রদান ছিল । সুতরাং মুসলমান আমাদিগকে পীড়ন করিতে পারিত কিন্তু অসম্মান করা তাহার সাধ্য ছিল না । মনে মনে আমাদের আত্মসম্মানের কোনো লাঘব ছিল না, কারণ বাহুবলের দ্বারা শ্রেষ্ঠত কিছুতেই অভিভূত হইতে পারে না । কিন্তু আমরা ইংরেজের রেলগাড়ি কলকারখানা রাজ্যশৃঙ্খলা দেখি আর ইা করিয়া ভাবি ইহারা ময়দানবের বংশ—ইহার এক জাতই স্বতন্ত্র, ইহাদের অসাধ্য কিছুই নহে—এই বলিয়া নিশ্চিন্তমনে রেলগাড়িতে চড়ি, কলের মাল সস্তায় কিনি এবং মনে করি ইংরেজের মুল্লুকে আমাদের আর কিছু ভয় করিবার চিস্ত করিবার চেষ্টা করিবার নাই—কেবল, পূর্বে ডাকাতে যাহা লইত এখন তাহ পুলিস এবং উকিলে মিলিয়া অংশ করিয়া লয় । এইরূপে মনের এক ভাগ যেরূপ নিশ্চিন্ত নিশ্চেষ্ট হয়, অপর ভাগে এমন কি, মনের গভীরতর মূলে ভার বোধ হইতে থাকে। খাদ্যরস এবং পাকরস মিশিয়া তবে আহার পরিপাক হয়, ইংরেজের সভ্যতা আমাদের পক্ষে খাদ্যমাত্র কিন্তু তাহাতে রসের একান্ত অভাব হওয়াতে আমাদের মন তদুপযুক্ত পাকরস নিজের মধ্য হইতে জোগাইতে পারিতেছে না । লইতেছি মাত্র কিন্তু পাইতেছি না। ইংরেজের সকল কার্যের ফলভোগ করিতেছি কিন্তু আমার করিতে পারিতেছি না, এবং করিবার আশাও নিরস্ত হইতেছে। রাজ্য জয় করিয়া গৌরব এবং লাভ আছে, রাজ্য সুশাসন করিয়া ধর্ম এবং অর্থ আছে, আর রাজাপ্রজার হৃদয়ের মিলন স্থাপন করিয়া কি কোনো মাহাত্ম্য এবং কোনো সুবিধা নাই ? বর্তমান কালের ভারত-রাজনীতির সেই কি সর্বাপেক্ষ চিন্তা এবং আলোচনার বিষয় নহে ? কেমন করিয়া হইবে তাহাই প্রশ্ন । একে একে তো দেখানে গিয়াছে যে, রাজপ্রজার মধ্যে দুর্ভেদ্য দুরূহ স্বাভাবিক বাধাসকল বর্তমান । কোনো কোনো