পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 9אס8 নেশা একেবারে বিষ। ভারতবর্ষে যাহারা কতৃত্ব করিতে আসেন, তাহারা অধিকাংশই এই মদিরায় অভ্যস্ত নহেন। তাহাদের স্বদেশ হইতে এ-দেশের পরিবর্তন অত্যন্ত বেশি। যাহার কোনোকালেই বিশেষ কেহু নহেন, এখানে তাহার একমুহূর্তেই হৰ্তাকর্তা । এমন অবস্থায় নেশার কোকে এই নূতনলন্ধ প্রতাপটাকেই তাহারা সকলের চেয়ে প্রিয় এবং শ্রেয় জ্ঞান করেন । প্রেমের পথ নম্রতার পথ। সামান্ত লোকেরও হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিতে হইলে নিজের মাথাটাকে তাহার দ্বারের মাপে নত করিতে হয়। নিজের প্রতাপ ও প্রেস্টিজ সম্বন্ধে যে-ব্যক্তি হঠাং-নবাবের মতো সর্বদাই আপাদমস্তক সচেতন, সে-ব্যক্তির পক্ষে এই নম্রতা দুঃসাধ্য। ইংরেজের রাজত্ব যদি ক্রমাগতই আনাগোনার রাজত্ব না হইত, যদি এ-দেশে তাহারা স্থায়ী হইয়া কতৃত্বের উগ্রতাটা কতকটা পরিমাণে সহ করিতে পারিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাহারা আমাদের সঙ্গে হৃদয়ের যোগস্থাপনের চেষ্টা করিতে বাধ্য হইত। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় ইংলণ্ডের অখ্যাত প্রান্ত হইতে কয়েক দিনের জন্ম এ-দেশে আসিয়া ইহার কোনোমতেই ভুলিতে পারে না যে, আমরা কর্তা— এবং সেই ক্ষুদ্র দম্ভটাকেই সর্বদা প্রকাশমান রাখিবার জন্য তাহারা আমাদিগকে সকল বিষয়েই অহরহ দূরে ঠেকাইয়া রাখে এবং কেবলমাত্র প্রবলতার দ্বারা আমাদিগকে অভিভূত করিয়া রাখিতে চেষ্টা করে । আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা যে তাহাদের রাজনীতিকে স্পর্শ করিতে পারে, এ-কথা তাহারা স্বীকার করিতে কুষ্ঠিত হয়। এমন কি, তাহাদের কোনো বিধানে আমরা যে বেদনা আতুভব ও বেদন প্রকাশ করিব, তাহাও তাছারা স্পধী বলিয়া জ্ঞান করে { কিন্তু স্বামী যতই কঠোর হউক না কেন সে স্ত্রীর কাছে যে কেবল বাধ্যত চাহে তাহা নহে, স্ত্রীর হৃদয়ের প্রতিও তাহার ভিতরে ভিতরে আকাজ থাকে । অথচ হৃদয় অধিকার করিবার ঠিক পথটি সে গ্রহণ করিতে পারে না, তাহার দুর্গম্য ঔৰত্যে বাধা দেয়। যদি তাহার সন্দেহ জন্মে যে, স্ত্রী তাহার আধিপত্য সহ করে কিন্তু তাঁহাকে ভালোবাসে না, তবে সে তাহার কঠোরতার মাত্রা বাড়াইতেই থাকে। প্রীতি জন্মাইবার ইহা যে প্রকৃষ্ট উপায় নহে, সে-কথা বলাই বাহুল্য। সেইরূপ ভারতবর্ষের ইংরেজ-রাজার আমাদের কাছ হইতে রাজভক্তির দাবিটুকুও ছাড়িতে পারে না । কিন্তু ভক্তির সম্বন্ধ হৃদয়ের সম্বন্ধ-সে-সঙ্গন্ধে দান-প্রতিদান আছেতাহা কলের সম্বন্ধ নহে । সে-সম্বন্ধ স্থাপন করিতে গেলেই কাছে আলিতে হয়, তাই শুদ্ধমাত্র জবরদস্তির কর্ম নহে। কিন্তু কাছেওঁ খেধিব না, হৃদয়ও দিব না