পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

0 - * রাজা প্রজা ৪৩৯ সেই পিতৃমাতৃত্ব জগতের পিতামাতারই প্রকাশ । ইন্দ্র-চন্দ্র-অগ্নি-বায়ুকে যে বেদে দেবতা বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে তাহারও এই কারণ ; শক্তিপ্রকাশের মধ্যে ভাৱতবৰ শক্তিমান পুরুষের সভা অনুভব না করিয়া কোনোদিন তৃপ্ত হয় নাই। “এইজন্ত বিশ্বভুবনে নানা উপলক্ষ্যে নানা আকারেই ভক্তিবিনম্র ভারতবর্ষের পূজা সমাহৃত হইয়াছে । জগৎ আমাদের নিকট সর্বদাই দেবশক্তিতে সজীব । এ-কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা যে, আমরা দীনতাবশতই প্রবলতার পূজা করিয়া থাকি। সকলেই জানে গাভীকেও ভারতবর্ষ পূজ্য করিয়াছে। গাভী যে পশু তাহা সে জানে না, ইহা নহে। মানুষ প্রবল এবং গাভাই দুর্বল। কিন্তু ভারতবর্ষীয় সমাজ গাভীর নিকট হইতে নানাপ্রকার মঙ্গল লাভ করে । সেই মঙ্গল মানুষ ষে নিজের গায়ের জোরে পশুর কাছ হইতে আদায় করিয়া লইতেছে, এই ঔদ্ধত্য ভারতবর্ষের মহে । সমস্ত মঙ্গলের মূলে সে দৈব অনুগ্রহকে প্রণাম করিয়া সকলের সঙ্গে আত্মীয়সম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারিলে তবে বঁাচে । কারিকর তাহার যন্থকে প্রণাম করে, যোদ্ধা তাহার তরবারিকে প্রণাম করে, গুণী তাহার বীণাকে প্রণাম করে ;–ইহার যে যন্থকে যন্ত্র বলিয়া জানে না তাহা নহে ; কিন্তু ইহাও জানে যন্ত্র একটা উপলক্ষ্যমাত্র— যন্ত্রের মধ্য হইতে সে যে আনন্দ বা উপকার লাভ করিতেছে, তাহা কাঠ বা লোহার দান নহে, কারণ, আত্মাকে আত্মীয় ছাড়া কোনো সামগ্রীমাত্রে স্পর্শ করিতে পারে না। এইজন্ম তাহাদের কৃতজ্ঞতা, তাহদের পূজা যিনি বিশ্বষন্থের যা তাহার নিকট এই যন্ত্রযোগেই সমৰ্পিত হয় । এই ভারতবর্ষ রাজশাসন-ব্যাপারকে যদি পুরুষরূপে নহে, কেবল যন্থরূপে অনুভব করিতে থাকে, তবে তাহার পক্ষে এমন পীড়াকুর আর-কিছুই হইতে পারে ম)। জডের মধ্যেও আত্মার সম্পর্ক অনুভব করিয়া তবে যাহার তৃপ্তি হয়, রাষ্ট্ৰতন্ত্রের মতে এতবড়ো মানব-ব্যাপারের মধ্যে সে হৃদয়ের প্রত্যক্ষ আবির্ভাবকে মূর্তিমান না দেখিয়া বাটে কিরূপে ? আত্মার সঙ্গে আত্মীয়ের সম্বন্ধ যেখানে আছে সেখানেই নত হওয়া যায়--যেখানে তাহা নাই সেখানে নত হইতে অহরহ বাধ্য হইলে অপমান ও পীড়া বোধ হয় ; অতএব রাষ্ট্রব্যাপারের মধ্যস্থলে আমরা দেবতার শক্তিকে মঙ্গলের প্রত্যক্ষস্বরূপকে রাজরূপে দেখিতে পাইলে শাসনের বিপুল ভার সহজে বহন করিতে পারি। নহিলে হৃদয় প্রতিক্ষণেই ভাঙিয়া যাইতে থাকে। আমরা পূজা করিতে চাই— রাজতন্ত্রের মধ্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়া তাহার সহিত আমাদের প্রাণের যোগ অনুভব করিতে চাই—-আমরা বলকে কেবলমাত্র বলরূপে সহ করিতে পারি না । অতএব ভারতবর্ষের রাজভক্তি প্রকৃতিগত এ-কথা সত্য। কিন্তু সেই জন্য