পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8良> SVC) নতুনকে দেখতে হলে, মনকে একটু বিশেষ করে বাতি জ্বালাতে হয় । পুরোনোকে দেখতে হলে, ভালো করে চোখ মেলতেই হয় না । সেইজন্যে নতুনকে যত শীঘ্ৰ পারে দেখে নিয়ে, মন আপনার অতিরিক্ত বাতিগুলো নিবিয়ে ফেলে। খরচ বাচাতে চায়, মনােযোগকে উসকে রাখতে চায় না। মুকুল আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, “দেশে থাকতে বই পড়ে, ছবি দেখে জাপানকে যেরকম বিশেষভাবে নতুন বলে মনে হত, এখানে কেন তা হচ্ছে না ।” তার কারণই এই । রেঙ্গুন থেকে আরম্ভ করে সিঙাপুর, হংকং দিয়ে আসতে আসতে মনের নতুন দেখার বিশেষ আয়োজনটুকু ক্রমে ক্রমে ফুরিয়ে আসে। যখন বিদেশী সমুদ্রের এ কোণে ও কোণে ন্যাড়া ন্যাড়া পাহাড়গুলো উকি মারতে থাকে তখন বলতে থাকি বাঃ ! তখন মুকুল বলে, ঐখানে নেবে গিয়ে থাকতে বেশ মজা ! ও মনে করে, এই নতুনকে প্রথম দেখার উত্তেজনা বুঝি চিরদিনই থাকবে ; ওখানে ঐ ছোটাে ছোটাে ঐখানে পৌছলে পরে সমুদ্রের চঞ্চলনীল, আকাশের শান্তনীল আর ঐ পাহাড়গুলোর ঝাপসা-নীল ছাড়া আর কিছুর দরকারই হয় না । তার পরে, বিরল ক্রমে অবিরল হতে লাগল, ক্ষণে ক্ষণে আমাদের জাহাজ এক-একটা দ্বীপের গা ঘেসে চলল ; তখন দেখি দূরবীন টেবিলের উপরে অনাদরে পড়ে থাকে, মন আর সাড়া দেয় না । যখন দেখবার সামগ্ৰী বেড়ে ওঠে তখন দেখাটাই কমে যায়। নতুনকে। ভোগ করে করে নতুনের খিদে ক্রমেই মরে যায় । হাপ্তাখানেক জাপানে আছি কিন্তু মনে হচ্ছে, যেন অনেক দিন আছি। তার মানে, পথঘাট, গাছপালা, লোকজনের যেটুকু নতুন সেটুকু তেমন গভীর নয়, তাদের মধ্যে যেটা পুরোনো সেইটেই পরিমাণে বেশি। অফুরান নতুন কোথাও নেই ; অর্থাৎ, যার সঙ্গে আমাদের চিরপরিচিত খাপ খায় না, জগতে এমন অসংগত কিছুই নেই। প্ৰথমে ধা করে চোখে পড়ে, যেগুলো হঠাৎ আমাদের মনের অভ্যাসের সঙ্গে মেলে না । তার পরে পুরোনোর সঙ্গে নতুনের যে যে অংশের রঙে মেলে, চেহারায় কাছাকাছি আসে, মন তাড়াতাড়ি সেইগুলোকে পাশাপাশি সাজিয়ে নিয়ে তাদের সঙ্গে ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয় । তাস খেলতে বসে আমরা হাতে কাগজ পেলে রঙ এবং মূল্য –অনুসারে তাদের পরে পরে সাজিয়ে নিই ; এও সেইরকম । শুধু তো নতুনকে দেখে যাওয়া নয়, তার সঙ্গে যে ব্যবহার করতে হবে ; কাজেই মন তাকে নিজের পুরোনো কাঠামোর মধ্যে যত শীঘ্ৰ পারে গুছিয়ে নেয়। যেই গোছানো হয় তখন দেখতে পাই, তত বেশি নতুন নয়। যতটা গোড়ায় মনে হয়েছিল ; আসলে পুরনো, ভঙ্গিটাই নতুন । তার পরে আর-এক মুশকিল হয়েছে এই যে, দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবীর সকল সভ্য জাতিই বর্তমান কালের ছাচে ঢালাই হয়ে একই রকম চেহারা অথবা চেহারার অভাব ধারণ করেছে । আমার এই জানলায় বসে কোবে শহরের দিকে তাকিয়ে এই যা দেখছি। এ তো লোহার। জাপান, এ তো রক্তমাংসের নয় । এক দিকে আমার জানলা, আর-এক দিকে সমুদ্র, এর মাঝখানে প্ৰকাণ্ড একটা শহর। চীনেরা যেরকম বিকটমূর্তি ড্রাগন আঁকে- সেইরকম । আঁকাবঁকা বিপুল দেহ নিয়ে সে যেন, সবুজ পৃথিবীটিকে খেয়ে ফেলেছে। গায়ে গায়ে ঘেঁষাৰ্ঘেষি লোহার চালগুলো ঠিক যেন তারই পিঠের আঁশের মতো রৌদ্রে ঝকঝকি করছে। বড়ো কঠিন, বড়ো কুৎসিত- এই দরকার-নামক দৈত্যটা । প্রকৃতির মধ্যে মানুষের যে অন্ন আছে তা ফলে শস্যে বিচিত্র এবং সুন্দর ; কিন্তু সেই অন্নকে যখন গ্রাস করতে যাই তখন তাকে তাল পাকিয়ে একটা পিণ্ড করে তুলি, তখন বিশেষত্বকে দরকারের চাপে পিষে ফেলি। কোবে শহরের পিঠের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, মানুষের দরকার পদার্থটা স্বভাবের বিচিত্রতাকে একাকার করে দিয়েছে। মানুষের দরকার আছে, এই কথাটাই ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে, ইহা করতে করতে, পৃথিবীর অধিকাংশকে গ্ৰাস করে ফেলছে। প্রকৃতিও কেবল দরকারের সামগ্ৰী, মানুষও কেবল দরকারের মানুষ হয়ে আসছে।