8brぐ2 রবীন্দ্র-রচনাবলী রচনায় খুব ব্যবহার করে থাকেন । তার প্রধান কারণ, সৌন্দৰ্য হচ্ছে একটা বিশিষ্টতা। জীবনের পথে চলতে চলতে অগণ্য বস্তুর ভিড়কে আমরা পাশ কাটিয়ে যাই । সুন্দর হঠাৎ বলে ওঠে, “চেয়ে দেখো।” প্রতিদিন হাজার হাজার জিনিসকে যা না বলি তাকে তাই বলি ; বলি, “তুমি আছ।” ঐটেই হল আসল কথা । সে-যে নিশ্চিত আছে, এই বার্তাটাই তার সৌন্দৰ্য আমার কাছে উপস্থিত করলে । সে-যে সৎ, এইটে একান্ত উপলব্ধি করতে পারলুম বলেই সে এত আনন্দ দিলে । শিশুর কাছে তার খেলার জিনিস মহার্ঘ্য বলেই দামি নয়, সুন্দর বলেই প্রিয় নয়। আপনি কল্পনাশক্তি দিয়ে তাকে স্পষ্ট উপলব্ধি করে বলেই ছেড়া নেকড়োয় তৈরি হলেও সে তার কাছে সত্য, এবং সত্য বলেই আনন্দময় ; কারণ, সত্যের রসই হচ্ছে আনন্দ । এক রকমের গায়ে-পড়া সৌন্দৰ্য আছে যা ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তির সঙ্গে যোগ দিয়ে অতিলালিত্যগুণে সহজে আমাদের মন ভোলায় । চোর। যেমন দ্বারীকে ঘুষ দিয়ে চুরি করতে ঘরে ঢেকে । সেইজন্যে যে-আট আভিজাত্যের গৌরব করে সে-আট এই সৌন্দর্যকে আমল দিতেই চায় না । একজাতের বাইজিমহলে চলতি খেলো সংগীত তার হালকা চালের সুরতালের উত্তেজনায় সাধারণ লোকের মনে নেশা ধরিয়ে দেয় । বড়ো ওস্তাদের এই নেশাধরানো কনভোলানো ফাকিকে অত্যন্ত অবজ্ঞা করেন । তাতে র্তারা সাধারণ লোকের সস্তা বিকশিশ থেকে বঞ্চিত হওয়াকেই পুরস্কার বলে মেনে নেন । তারা যে বিশিষ্টতাকে আর্টের সম্পদ বলে জানেন সে-বিশিষ্টতা প্রলোভননিরপেক্ষ উৎকর্ষ। তাকে দেখাতে গেলে যেমন সাধনা, তাকে পেতে গেলেও তেমনি সাধনা চাই । এইজন্যেই তার মূল্য । নিরলংকার হতে তার ভয় নেই। সরলতার অভাবকে, আড়ম্বরকে সে ইতর বলে ঘূণা করে । সুললিত বলে নিজের পরিচয় দিতে সে লজা বোধ করে, সুসংগত বলেই তার গৌরব । গীতায় আছে, কর্মের বিশুদ্ধ মুক্তরূপ হচ্ছে তার নিষ্কামরূপ। অর্থাৎ, ত্যাগের দ্বারা নয়, বৈরাগ্যের দ্বারাই কর্মের বন্ধন চলে যায় । তেমনি ভোগেরও বিশুদ্ধরূপ আছে, সেই রূপটি পেতে গেলে বৈরাগ্য চাই। বলতে হয়, মা গৃধঃ, লোভ কোরো না । সৌন্দর্যভোগ মনকে জাগাবে, এইটেই তার স্বধর্ম ; তা না করে মনকে যখন সে ভোলাতে বসে তখন সে আপনার জাত খোয়ায়, তখন সে হয়ে যায়। নীচ । উচ্চ-অঙ্গের আর্ট এই নীচতা থেকে বহু যত্নে আপনাকে বাচাতে চায় । লোভীর ভিড় তাড়াবার জন্যে সে অনেক সময়ে কঠোরকে দ্বারের কাছে বসিয়ে রাখে, এমন-কি, অনেক সময় কিছু বিশ্ৰী, কিছু বেসুর তার রচনার সঙ্গে মিশিয়ে দেয় । কেননা, তার সাহস আছে ; সে জানে, যে-বিশিষ্টতা আর্টের প্রাণ তার সঙ্গে গায়ে পড়ে মিষ্টি মিশেল করবার কোনো দরকার নেই। উমার হৃদয় পাবার জন্যে শিবকে কন্দৰ্প সাজতে হয় নি । বিশেষকে দেখবার আর-একটা কৌশল আছে, সে হচ্ছে নূতনত্ব । অতিপরিচয়ের আবরণে বিশেষ পারে । এই প্ৰলোভন আটিস্টের তপোভঙ্গের কারণ । অতিপরিচয়ের স্নানতার মধ্যেই চির-বিশেষের উজ্জ্বলরাপ দেখাতে পারে যে-গুণী সেই তো গুণী । যেখানটা সর্বদা আমাদের চােখে পড়ে অথচ দেখতে পাই নে, সেইখানেই দেখবার জিনিসকে দেখানো হচ্ছে আটিস্টের কােজ । সেইজন্যেই তো বড়ো বড়ো আটিস্টের রচনার বিষয় চিরকালের জিনিস। আট পুরাতনকে বারে বারে নূতন করে । বিশেষকে সে দেখতে পায় হাতের কাছে, ঘরের কাছে। সৃষ্টি তো খনির জিনিস নয় যে খুঁড়তে খুঁড়তে তার পুঁজি ফুরিয়ে যাবে। সে-যে ঝরনা ; তার প্রাচীন ধারা যে চিরদিনই নবীন হয়ে বইছে, এইটে প্রমাণ করবার জন্যে তাকে কোনো অদ্ভুত ভঙ্গি করতে হয় না। অশোকের মঞ্জীর কালিদাসের আমলেও যে-রঙে বসন্তের শ্যামল বক্ষ রাঙিয়ে দিয়েছে আজও নুতনত্বের ভান করে সেই রঙ বদল করবার তার দরকার হয় নি । নিৰ্ভয়ে সে বর্ষে বর্ষে পুরাতনের বাসরঘরেই নবীনের ঘোমটা খুলে দিচ্ছে । বারে বারেই চোখের উপর থেকে জড়তার মোহ কেটে যাচ্ছে, আর চিরবিশেষকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, ইটের ঢেলার চেয়ে অশোকমঞ্জরীকেই বিশেষ করে দেখি কেন, এইটেই দাড়ায় প্রশ্ন । এর উত্তর এই যে, আপন অংশ-প্ৰত্যংশের সমাবেশ নিয়ে অশোক আপনার মধ্যে একটি সুসংগত
