পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ O8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এই বকে—যাওয়াটা মনের জীবনের লীলা । দেহটা কেবলমাত্র চলবার জন্যেই বিনা-প্রয়োজনে মাঝে মাঝে এক-একবার ধ্যা করে চলে ফিরে আসে । বাজার করবার জন্যেও নয়, সভা করবার জন্যেও নয়, নিজের চলাতেই সে নিজে আনন্দ পায় বলে । তেমনি নিজের বকুনিতেই মন জীবনধর্মের তৃপ্তি পায় । তাই বকবার অবকাশ চাই, লোক চাই। বক্তৃতার জন্যে লোক চাই অনেক, বিকার জন্যে aris-Vere দেশে অভ্যস্ত জায়গায় থাকি নিত্যনৈমিত্তিক কাজের মধ্যে, জানা অজানা লোকের ভিড়ে । নিজের সঙ্গে নিজের আলাপ করবার সময় থাকে না । সেখানে নানা লোকের সঙ্গে নানা কেজো কথা নিয়ে কারবার। সেটা কেমনতরো। যেন বাধা পুকুরের ঘাটে দশজনে জটলা করে জল ব্যবহার। কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা চাতকের ধর্ম আছে ; হাওয়ায় উড়ে-আসা মেঘের বর্ষণের জন্যে সে চেয়ে থাকে একা একা । মনের আকাশে উড়ো ভাবনাগুলো সেই মেঘ- সেটা খামখেয়ালের ঝাপটা লেগে ; তার আবির্ভাব তিরোভাব সবই আকস্মিক । প্রয়োজনের তাগিদমত তাকে বাধা-নিয়মে পাওয়া যায় না। বলেই তার বিশেষ দাম ; পৃথিবী আপনারই বাধা জলকে আকাশে উড়ো জল করে দেয় ; নিজের ফসলখেতকে সরস করবার জন্যে সেই জলের দরকার । বিনা প্ৰয়োজনে নিজের মনকে কথা বলাবার সেই প্রয়োজন, সেটাতে মন আপনি ধারাতেই আপনাকে অভিষিক্ত করে । , জীবনযাত্রার পরিচিত ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে মন আজ যা-তা ভাববার সময় পেল । তাই ভেবেছি, কোনো সম্পাদক বৈঠক স্মরণ করে প্রবন্ধ আওড়াব না, চিঠি লিখব তোমাকে । অর্থাৎ, পাত পেড়ে ভোজ দেওয়া তাকে বলা চলবে না ; সে হবে গাছতলায় দাডিয়ে হাওয়ায় পড়ে।-যাওয়া ফল আঁচলে, ভরে দেওয়া । তার কিছু পাকা, কিছু কাচা ; তার কোনোটাতে রং ধরেছে, কোনোটাতে ধরে নি। তার কিছু রাখলেও চলে, কিছু ফেলে দিলেও নালিশ চলবে না । সেই ভাবেই চিঠি লিখতে শুরু করেছিলুম। কিন্তু, আকাশের আলো দিলে মুখ-ঢাকা । বৈঠকখানার আসর বন্ধ হয়ে গেলে ফরাশ বাতি নিবিয়ে দিয়ে যেমন ঝাডলণ্ঠনে ময়লা রঙের ঘেরাটোেপ পরিয়ে দেয়, দুলোকের ফরাশ সেই কাণ্ডটা করলে, একটা ফিকে ধোয়াটে রঙের আবরণ দিয়ে আকাশসভার তৈজসপত্র দিলে মুড়ে । এই অবস্থায় আমার মন তার হালকা কলমের খেলা আপনিই বন্ধ করে দেয়। বকুনির কুলহারা ঝরনা বাক্যের নদী হয়ে কখন একসময় গভীর খাদে চলতে আরম্ভ করে ; তখন তার চলাটা কেবলমাত্র সূর্যের আলোয় কলধ্বনির নূপুর বাজানোর জন্যে নয়, একটা কোনো লক্ষ্যে পৌছবার সাধনায় । আনমনা সাহিত্য তখন লোকালয়ের মাঝখানে এসে পড়ে সমনস্ক হয়ে ওঠে । তখন বাণীকে অনেক বেশি অতিক্রম করে ভাবনাগুলো মাথা তুলে দাঁড়ায় । উপনিষদে আছে : স নো বন্ধুর্জনিতা স বিধাতা ; তিনি ভালোবাসেন, তিনি সৃষ্টি করেন, আবার তিনিই বিধান করেন । সৃষ্টি-করাটা সহজ আনন্দের খেয়ালে, বিধান-করায় চিন্তা আছে । যাকে খাস সাহিত্য বলে সেটা হল সেই সৃষ্টিকর্তার এলেকায়, সেটা কেবল আপন মনে। যদি কোনাে হিসাবি লোক স্রষ্টাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে “কোন সৃষ্টি করা হল”। তিনি জবাব দেন, “আমার খুশি !” সেই খুশিটাই নানা রঙে নানা রসে আপনাতেই আপনি পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে। পদ্মফুলকে যদি জিজ্ঞাসা করো “তুমি কেন হলে” সে বলে, “আমি হবার জন্যেই হলুম।” খাটি সাহিত্যেরও সেই একটিমাত্র জবাব । অর্থাৎ, সৃষ্টির একটা দিক আছে যেটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার বিশুদ্ধ বকুনি । সেদিক থেকে এমনও বলা যেতে পারে, তিনি আমাকে চিঠি লিখছেন । আমার কোনো চিঠির জবাবে নয়, তার আপনার বলতে ইচ্ছে হয়েছে বলে ; কাউকে তো বলা চাই । অনেকেই মন দিয়ে শোনে না, অনেকে বলে, “এ তো সারবান নয় ; এ তো বন্ধুর আলাপ, এ তো সম্পত্তির দলিল নয়।” সারবান থাকে মাটির গর্ভে, সোনার খনিতে ; সে নেই ফুলের বাগানে, নেই সে উদয়দিগন্তে মেঘের মেলায় । আমি একটা গৰ্ব করে থাকি, ঐ চিঠিলিখিয়ের চিঠি পড়তে পারতপক্ষে কখনো ভুলি নে । বিশ্ববকুনি যখন-তখন আমি শুনে থাকি । তাতে বিষয়কাজের ক্ষতি হয়েছে, আর যারা আমাকে দলে ভিড়িয়ে কাজে লাগাতে চায় তাদের কাছ থেকে নিন্দাও শুনেছি ; কিন্তু আমার এই দশা ।