পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী এখানকার ভারতীয়েরাও একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাকে অভ্যর্থনা উপলক্ষে এখানকার রাজপুরুষ ও অন্য অনেককে নিমন্ত্রণ করে চা খাইয়েছিলেন । সেদিন আমি কিছু দক্ষিণাও পেয়েছি। এইভাবে এখানে কেটে গেল, একেবারে এদের বাড়ির ভিতরেই । আঙিনায় অনেকগুলি গাছ ও লতাবিতান । আমগাছ, সপেটা, আতা। যো-জাতের আমি তাকে এরা বলে মধু, এদের মতে বিশেষভাবে স্বাদু। এবার যথেষ্ট বৃষ্টি হয় নি বলে আমগুলো কাচা অবস্থাতেই ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। এখানে ভোজনকালে যে-আমি খেতে পেয়েছি দেশে থাকলে সে-আম কেনার পয়সাকে অপব্যয় আর কেটে খাওয়ার পরিশ্রমটাকে বৃথা ক্লাস্তিকর বলে স্থির করতুম, কিন্তু এখানে তার আদরের ক্রটি হয় নি । এই আঙিনায় লতামণ্ডপের ছায়ায় আমাদের গৃহকত্রী প্রায়ই বেলা কাটান । চার দিকে শিশুরা গোলমাল করছে, খেলা করছে- সঙ্গে তাদের বুড়ি ধাত্রীরা । মেয়েরা যেখানে-সেখানে বসে কাপড়ের উপর এদেশে-প্রচলিত সুন্দর বাতির ছাপ-দেওয়া কাজে নিযুক্ত । গৃহকর্মের নানা প্ৰবাহ এই ছায়াসিন্ধ নিভৃত প্রাঙ্গণের চার দিকে আবর্তিত । পরশু সুরবায়া থেকে দীর্ঘ রেলপথ ও রৌদ্রতাপক্লিষ্ট অপরাহের ছ’টি ঘণ্টা কাটিয়ে তিনটের সময় সুরকর্তায় পৌঁচেছি। জাভার সব চেয়ে বড়ো রাজপরিবারের এইখানেই অবস্থান । ওলন্দাজেরা এঁদের রাজপ্ৰতাপ কেড়ে নিয়েছে কিন্তু প্ৰতিপত্তি কাড়তে পারে নি । এই বংশেরই একটি পরিবারের বাড়িতে আছি। তাদের উপাধি মথুনগরো ; এঁদেরই এক শাখা সুরবায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। প্রাসাদের একটি নিভৃত অংশ আমরাই অধিকার করে আছি। এখানে স্থান প্রচুর, আরামের উপকরণ যথেষ্ট, আতিথ্যের উপদ্রব নেই । রাজবাডি বহুবিস্তীর্ণ, বহুবিভক্ত । আমরা যেখানে আছি তার প্রকাণ্ড একটি অলিন্দ, সাদা মার্বিল পাথরে বাধানো, সারি সারি কাঠের থামের উপরে ঢালু কাঠের ছাদ । এই রাজপরিবারের বর্ণলাঞ্ছন হচ্ছে সবুজ ও হলদে, তাই এই অলিন্দের থাম ও ছাদ সবুজে সোনালিতে চিত্রিত । অলিন্দের এক ধারে গামেলান-সংগীতের যন্ত্র সাজানো । বৈচিত্র্যেও কম নয়, সংখ্যাতেও অনেক । সাত সুরের ও পােচ সুরের ধাতুফলকের যন্ত্র অনেক রকমের, অনেক আয়তনের, হাতুড়ি দিয়ে বাজাতে হয় । ঢোলের আকার ঠিক আমাদের দেশেরই মতো, বাজাবার বোল ও কায়দা অনেকটা সেই ধরনের । এ ছাড়া বঁাশি, আর ধনু দিয়ে বাজাবার তাতের যন্ত্র । রাজা স্টেশনে গিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করে এনেছিলেন । সন্ধ্যাবেলায় একত্ৰ আহারের সময় তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ হল । অল্প বয়স, বুদ্ধিতে উজ্জ্বল মুখশ্ৰী । ডাচ ভাষায় আধুনিক কালের শিক্ষা পেয়েছেন ; ইংরেজি অল্প অল্প বলতে ও বুঝতে পারেন । খেতে বসবার আগে বারান্দার প্রান্তে বাজনা বেজে উঠল, সেইসঙ্গে এখানকার গানও শোনা গেল । সে-গানে আমাদের মতো আস্থায়ী-অন্তরার বিভাগ নেই। একই ধুয়ো বার বার আবৃত্তি করা হয়, বৈচিত্ৰ্য যা-কিছু তা যন্ত্র বাজনায়। পূর্বের চিঠিতেই বলেছি, এদের যন্ত্রবাজনােটা তাল দেবার উদ্দেশে । আমাদের দেশে বায়া তবলা প্ৰভৃতি তালের যন্ত্র যে-সপ্তকে গান ধরা হয় তারই সা সুরে বাধা ; এখানকার তালে যন্ত্রে গানের সব সুরগুলিই আছে। মনে করো, “তুমি যেয়ো না এখনি, এখনো আছে। রজনী” ভৈরবীর এই এক ছত্র । মাত্র কেউ যদি ফিরে ফিরে গাইতে থাকে। আর নানাবিধ যন্ত্রে ভৈরবীর সুরেই যদি তালের বোল দেওয়া হয়, আর সেই বোল-যোগেই যদি ভৈরবী রাগিণীর ব্যাখ্যা চলে তা হলে যেমন হয় এও সেইরকম । পরীক্ষা করে দেখলে দেখা যাবে, শুনতে ভালোই লাগে, নানা আওয়াজের ধাতুবাদ্যে সুরের নৃত্যে আসার খুব জমে ওঠে । খেয়ে এসে আবার আমরা বারান্দায় বসলুম । নাচের তালে দুটি অল্প বয়সের মেয়ে এসে মেজের উপর পাশাপাশি বসল। বড়ো সুন্দর ছবি । সাজে সজায় চমৎকার সুছন্দ । সোনায়-খচিত মুকুট মাথায়, গলায় সোনার হারে অর্ধচন্দ্রাকার হাঁসুলি, মণিবন্ধে সোনার সর্পকুণ্ডলী বালা, বাহুতে একরকম সোনার বাজুবন্দ- তাকে এরা বলে কীলকবাহু । কঁাধ ও দুই বাহু অনাবৃত, বুক থেকে কোমর পর্যন্ত সোনায়-সবুজে-মেলানো আঁটি কঁচুলি ; কোমরবন্দ থেকে দুই ধারার বস্ত্ৰাঞ্চল কেঁচার মতো সামনে দুলছে। কোমর থেকে পা পর্যন্ত শাড়ির মতোই বস্ত্ৰবেষ্টনী, সুন্দর বর্তিকশিল্পে বিচিত্র ; দেখবামাত্রই