পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মালঞ্চ > পিঠের দিকে বালিশগুলো উচু-কর। নীরজ আধ-শোওয়৷ পড়ে আছে রোগশয্যায়। পায়ের উপরে সাদা রেশমের চাদর টানা, যেন তৃতীয়ার ফিকে জ্যোৎস্না হালকা মেঘের তলায়। ফ্যাকাশে তার শাখের মতে রং, ঢিলে হয়ে পড়েছে চুড়ি, রোগী হাতে নীল শিরার রেখা, ঘনপক্ষ্ম চোখের পল্লবে লেগেছে রোগের কালিমা । মেঝে সাদা মারবেলে বাধানো, দেয়ালে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ছবি, ঘরে পালঙ্ক, একটি টিপাই, দুটি বেতের মোড়া আর এক কোণে কাপড় ঝোলাবার আলনা ছাড়া অন্য কোনো আসবাব নেই ; এক কোণে পিতলের কলসিতে রজনীগন্ধীর গুচ্ছ, তারই মৃদু গন্ধ বাধা পড়েছে ঘরের বদ্ধ হাওয়ায় । পুবদিকে জানলা খোলা। দেখা যায় নিচের বাগানে অরকিডের ঘর, ছিটে বেড়ায় তৈরি ; বেড়ার গায়ে গায়ে অপরাজিতার লতা। অদূরে ঝিলের ধারে পাম্প চলছে, জল কুলকুল করে বয়ে যায় নালায় নালায়, ফুলগাছের কেয়ারির ধারে ধারে । গন্ধনিবিড় আমবাগানে কোকিল ডাকছে যেন মরিয়া হয়ে । বাগানের দেউড়িতে টং টং করে ঘণ্টা বাজল বেলা দুপুরের। কী বা রৌদ্রের সঙ্গে তার স্বরের মিল। তিনটে পর্যন্ত মালীদের ছুটি । ওই ঘণ্টার শব্দে নীরজার বুকের ভিতরটা ব্যথিয়ে উঠল, উদাস হয়ে গেল তার মন । আয় এল দরজা বন্ধ করতে। নীরু বললে, না না থাক। চেয়ে রইল যেখানে ছড়াছড়ি যাচ্ছে রৌদ্র-ছায়। গাছগুলোর তলায় তলায় । - ফুলের ব্যবসায়ে নাম করেছে তার স্বামী আদিত্য। বিবাহের পরদিন থেকে নীরজার ভালোবাসা আর তার স্বামীর ভালোবাসা নানা ধারায় এসে মিলেছে এই বাগানের নানা সেবায় নানা কাজে । এখানকার ফুলে পল্লবে দুজনের সম্মিলিত আনন্দ নব নব রূপ নিয়েছে নব নব সৌন্দর্যে। বিশেষ বিশেষ ডাক আসবার দিনে বন্ধুদের কাছ থেকে প্রবাসী যেমন অপেক্ষা করে চিঠির, ঋতুতে ঋতুতে তেমনই ওরা অপেক্ষ করেছে ভিন্ন ভিন্ন গাছের পুঞ্জিত অভ্যর্থনার জন্যে । আজ কেবল নীরজার মনে পড়ছে সেইদিনকণর ছবি । বেশি দিনের কথা নয়, তৰু মনে হয় যেন একটা তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে যুগান্তরের ইতিহাস। বাগানের