পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩৬ । রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রাচ্য ও প্রতীচ্য আমি যখন যুরোপে গেলুম তখন কেবল দেখলুম, জাহাজ চলছে, গাড়ি চলছে, লোক চলছে, দোকান চলছে, থিয়েটার চলছে, পালামেণ্ট চলছে,– সকলেই চলছে । ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সকল বিষয়েই একটা বিপর্যয় চেষ্টা অহৰ্নিশি নিরতিশয় ব্যস্ত হয়ে রয়েছে ; মানুষের ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমা পাবার জন্যে সকলে মিলে আশ্রাস্তভাবে ধাবিত হচ্ছে । দেখে আমার ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে, এবং সেই সঙ্গে বিস্ময়-সহকারে বলে— হা, এরাই রাজার জাত বটে। আমাদের পক্ষে যা যথেষ্টের চেয়ে ঢের বেশি এদের কাছে তা অকিঞ্চন দারিদ্র্য। এদের অতি সামান্য সুবিধাটুকুর জন্যেও, এদের অতি ক্ষণিক আমোদের উদ্দেশেও মানুষের শক্তি আপন পেশী ও স্বায়ু চরম সীমায় অাকর্ষণ করে খেটে মরছে। জাহাজে বসে ভাবতুম এই যে জাহাজটি অহৰ্নিশি লৌহবক্ষ বিস্ফারিত করে চলেছে, ছাদের উপরে নরনারীগণ কেউ-বা বিশ্রামস্থখে, কেউ-বা ক্রীড়াকৌতুকে নিযুক্ত ; কিন্তু এর গোপন জঠরের মধ্যে যেখানে অনন্ত অগ্নিকুণ্ড জলছে, যেখানে অঙ্গারকৃষ্ণ নিরপরাধ নারকীর প্রতিনিয়তই জীবনকে দগ্ধ করে সংক্ষিপ্ত করছে সেখানে কী অসহ চেষ্টা, কী দুঃসাধ্য পরিশ্রম, মানবজীবনের কী নির্দয় অপব্যয় অশ্রান্তভাবে চলেছে। কিন্তু কী করা যাবে। আমাদের মানব-রাজ চলেছেন ; কোথাও তিনি থামতে চান না ; অনর্থক কাল নষ্ট কিংবা পথকষ্ট সহ করতে তিনি অসম্মত । র্তার জন্যে অবিশ্রাম যন্ত্রচালনা করে কেবলমাত্র দীর্ঘ পথকে হ্রাস করাই যথেষ্ট নয় ; তিনি প্রাসাদে যেমন আরামে, যেমন ঐশ্বর্ষে থাকেন পথেও তার তিলমাত্র ক্রটি চান না। সেবার জন্যে শত শত ভৃত্য অবিরত নিযুক্ত, ভোজনশালা সংগীতমণ্ডপ সুসজ্জিত স্বর্ণচিত্রিত শ্বেতপ্রস্তরমণ্ডিত শত বিদ্যুদীপে সমুজ্জল । আহারকালে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ-প্লেয়ের সীমা নেই। জাহাজ পরিষ্কার রাখবার জন্যে কত নিয়ম কত বন্দোবস্ত ; জাহাজের প্রত্যেক দড়িটুকু যথাস্থানে সুশোভনভাবে গুছিয়ে রাখবার জন্য কত দৃষ্টি । যেমন জাহাজে, তেমনি পথে ঘাটে দোকানে নাট্যশালায় গৃহে সর্বত্রই আয়োজনের অার অবধি নেই। দশদিকেই মহামহিম মানুষের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের ষোড়শোপচারে পূজা হচ্ছে। তিনি মুহূর্তকালের জন্যে যাতে সন্তোষ লাভ করবেন তার জন্যে সংবৎসরকাল চেষ্টা চলছে।