পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

83 to . রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছু পূর্বে এরূপ আন্তরিক দ্বিধা আমাদের শিক্ষিতসমাজে ছিল না। স্বদেশাভিমানীরা মুখে যিনি যাহাই বলিতেন, আধুনিক সভ্যতার উপর তাহাদের অটল বিশ্বাস ছিল। ফরাসীবিদ্রোহী, দাসত্ববারণচেষ্টা এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রত্যুষকালীন ইংরেজি কাব্যসাহিত্য বিলাতি সভ্যতাকে যে ভাবের ফেনায় ফেনিল করিয়া তুলিয়াছিল, তখনও তাহা মরে নাই— সে-সভ্যতা জাতিবর্ণনির্বিচারে সমস্ত মনুষ্যত্বকে বরণ করিতে প্রস্তুত আছে, এমনই একটা আশ্বাসবাণী ঘোষণা করিতেছিল। আমাদের তাহাতে তাক লাগিয়া গিয়াছিল। আমরা সেই সভ্যতার ঔদার্যের সহিত ভারতবর্ষীয় সংকীর্ণতার তুলনা করিয়া যুরোপকে বাহবা দিতেছিলাম। বিশেষত আমাদের মতো অসহায় পতিতজাতির পক্ষে এই ঔদার্য অত্যন্ত রমণীয় । সেই অতিবদান্ত সভ্যতার আশ্রয়ে আমরা নানাবিধ সুলভ সুবিধা ও অনায়াসমহত্ত্বের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম। মনে আশা হইতে লাগিল, কেবল স্বাধীনতার বুলি আওড়াইয়া আমরা বীরপুরুষ হইব, এবং কলেজ হইতে দলে দলে উপাধিগ্রহণ করিয়াই আমরা সাম্যসৌভ্রাত্রস্বাতন্ত্র্যমন্ত্রদীক্ষিত পাশ্চাত্য সভ্যতার নিকট হইতে স্বাধীনশাসনের দাবি করিব । চৈতন্য যখন ভক্তিবদ্যায় ব্রাহ্মণচণ্ডালের ভেদবাধ ভাঙিয়া দিবার কথা বলিলেন তখন যে-হীনবর্ণ সম্প্রদায় উৎফুল্প হইয়া ছুটিল, তাহারা বৈষ্ণব হইল কিন্তু ব্রাহ্মণ হইল না। আমরাও সভ্যতার প্রথম ডাক শুনিয়া যখন নাচিয়াছিলাম তখন মনে করিয়াছিলাম, এই পাশ্চাত্যমন্ত্র গ্রহণ করিলেই আর জেতাবিজেতার ভেদ থাকিবে না— কেবল মন্ত্রবলে গেীরে-স্যামে একাঙ্গ হইয়া যাইবে । এইজন্যই আমাদের এত বেশি উচ্ছাস হইয়াছিল এবং বায়রণের সুরে সুর বঁাধিয়া এমন উচ্চ সপ্তকে তান লাগাইয়াছিলাম। এমন পতিতপাবন সভ্যতাকে পতিতজাতি যদি মাথায় করিয়া না লইবে, তবে কে লইবে । কিন্তু আমরা বৈষ্ণব হইলাম, ব্রাহ্মণ হইলাম না। আমাদের যাহাকিছু ছিল ছাড়িতে প্রস্তুত হইলাম, কিন্তু ভেদ সমানই রহিয়া গেল। এখন মনে মনে ধিক্কার জন্মিতেছে ; ভাবিতেছি, কিসের জন্য— ঘর কৈমু বাহির, বাহির কৈমু ঘর, পর কৈমু আপন, আপন কৈম্বু পর ! বাশি বাজিয়াছিল মধুর, কিন্তু এখন মনে হইতেছে— যে ঝাড়ের তরল বঁাশি তারি লাগি পাও, ডালে মূলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাও ।