পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হালদারগোষ্ঠী এই পরিবারটির মধ্যে কোনোরকমের গোল বাধিবার কোনো সংগত কারণ ছিল না । অবস্থাও সচ্ছল, মানুষগুলিও কেহই মন্দ নহে, কিন্তু তবুও গোল বাধিল । কেননা, সংগত কারণেই যদি মানুষের সব-কিছু ঘটিত তবে তো লোকালয়টা একটা অঙ্কের খাতার মতো হইত, একটু সাবধানে চলিলেই হিসাবে কোথাও কোনো ভুল ঘটিত না ; যদি-বা ঘটিত সেটাকে রবার দিয়া মুছিয়া সংশোধন করিলেই চলিয়া যাইত । কিন্তু, মানুষের ভাগ্যদেবতার রসবোধ আছে ; গণিতশাস্ত্ৰে তাহার পাণ্ডিত্য আছে কি না জানি না, কিন্তু অনুরাগ নাই ; মানবজীবনের যোগবিয়োগের বিশুদ্ধ অঙ্কফলটি উদ্ধার করিতে তিনি মনোযোগ করেন না । এইজন্য তাহার ব্যবস্থার মধ্যে একটা পদার্থ তিনি সংযোগ করিয়াছেন, সেটা অসংগতি । যাহা হইতে পারিত সেটাকে সে হঠাৎ আসিয়া লণ্ডভণ্ড করিয়া দেয় । ইহাতেই নাট্যলীলা জমিয়া উঠে, সংসারের দুই কুল ছাপাইয়া হাসিকান্নার তুফান চলিতে থাকে । 要 এ ক্ষেত্রেও তাহাঁই ঘটিল- যেখানে পদ্মবন সেখানে মত্তহস্তী আসিয়া উপস্থিত । পঙ্কের সঙ্গে পঙ্কজের একটা বিপরীত রকমের মাখামাখি হইয়া গেল ; তা না হইলে এ গল্পটির সৃষ্টি হইতে পারিত | যে পরিবারের কথা উপস্থিত করিয়াছি তাহার মধ্যে সব চেয়ে যোগ্য মানুষ যে বনোয়ারিলাল, তাহাতে সন্দেহ নাই । সে নিজেও তাহা বিলক্ষণ জানে এবং সেইটোতেই তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। যোগ্যতা এঞ্জিনের সটীমের মতো তাহাকে ভিতর হইতে ঠেলে ; সামনে যদি সে রাস্তা পায় তো ভালোই, যদি না পায়। তবে যাহা পায় তাহাকে ধাক্কা মারে । তাহার বাপ মনোহরলালের ছিল সাবেককেলে বড়োমানুষি চাল । যে-সমাজ তাহার সেই সমাজের মাথাটিকেই আশ্রয় করিয়া তিনি তাহার শিরোভূষণ হইয়া থাকিবেন, এই তাহার ইচ্ছা । সুতরাং সমাজের হাত-পায়ের সঙ্গে তিনি কোনো সংস্রব রাখেন না । সাধারণ লোকে কাজকর্ম করে, চলে ফেরে ; তিনি কাজ না-করিবার ও না-চলিবার বিপুল আয়োজনটির কেন্দ্ৰস্থলে ধ্রুব হইয়া বিরাজ করেন । প্রায় দেখা যায়, এই প্রকার লোকেরা বিনাচেষ্টায় আপনার কাছে অন্তত দুটি-একটি শক্ত এবং খাটি লোককে যেন চুম্বকের মতো টানিয়া আনেন । তাহার কারণ আর কিছু নয়, পৃথিবীতে একদল লোক জন্মায় সেবা করাই তাঁহাদের ধর্ম। তাহারা আপন প্রকৃতির চরিতার্থতার জন্যই এমন অক্ষম মানুষকে চায় যে-লোক নিজের ভার ষোলোআ নাই তাহদের উপর ছাড়িয়া দিতে পারে । এই সহজ সেবকেরা নিজের কাজে কোনো সুখ পায় না, কিন্তু আর-একজনকে নিশ্চিন্ত করা, তাহাকে সম্পূর্ণ আরামে রাখা, তাহাকে সকল প্রকার সংকট হইতে বঁাচাইয়া চলা, লোকসমাজে তাহার সম্মান বৃদ্ধি করা, ইহাতেই তাহাদের পরম উৎসাহ । ইহারা যেন এক প্রকারের পুরুষ-মা ; তাহাও নিজের ছেলের নহে, পরের ছেলের । মনোহরলালের যে চাকরীটি আছে, রামচরণ, তাহার শরীররক্ষা ও শরীরপাতের একমাত্ৰ লক্ষ্য বাবুর দেহ রক্ষা করা । যদি সে নিশ্বাস লইলে বাবুর নিশ্বাস লইবার প্রয়োজনটুকু বাচিয়া যায় তাহা হইলে সে S SR | | SR O