পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

‘গল্পগুচ্ছ 8 Σ. Σ তার টেকনিকে সুস্পষ্ট গলদ । এই পরমনিন্দিত চিত্রকর একদিন আপিসের বড়োবাবুর অবর্তমানে এলেন তার মামির বাড়িতে । দ্বারে ধাক্কা মেরে মেরে ঘরে যখন প্ৰবেশলাভ করলেন, দেখলেন মেঝেতে পা ফেলবার জো নেই। ব্যাপারখানা ধরা পড়ল । রঙ্গলাল বললেন, “এতদিন পরে দেখা গেল, গুণীর প্রাণের ভিতর থেকে সৃষ্টিমূর্তি তাজা বেরিয়েছে, এর মধ্যে দাগা-বুলোনোর তো কোনো লক্ষণ নেই, যে-বিধাতা রূপ সৃষ্টি করেন তার বয়সের সঙ্গে ওর বয়সের মিল আছে। সব ছবিগুলো বের করে আমাকে দেখাও ।” কোথা থেকে বের করবে । যে-গুণী রঙে রঙে ছায়ায় আলোয় আকাশে আকাশে চিত্র আঁকেন তিনি তার কুহেলিকা-মরীচিকাগুলি যেখানে অকাতরে সরিয়ে ফেলেন, এদের কীর্তিগুলোও সেইখানেই গেছে। রঙ্গলাল মাথার দিব্যি দিয়ে তঁর মামিকে বললেন, “এবার থেকে তোমরা যা-কিছু রচনা করবে: আমি এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যাব।” বড়োবাবু এখনো আসেন নি। সকাল থেকে শ্রাবণের ছায়ায় আকাশ ধ্যানমগ্ন, বৃষ্টি পড়ছে ; বেলা ঘড়ির কাটার কোন সংকেতের কাছে তার ঠিকানা নেই, তার খোজ করতেও মন যায় না। আজ চুনিবাবু নীেকো-ভাসানোর ছবি আঁকতে লেগেছেন । নদীর ঢেউগুলো মকরের পাল, হা করে নীেকোটাকে গিলতে চলেছে এমনিতরো ভাব ; আকাশের মেঘগুলোও যেন উপর থেকে চাদর উড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে- কিন্তু, মকরগুলো সর্বসাধারণের মকর নয়, আর মেঘগুলোকে ‘ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতাং সন্নিবেশঃ' বললে অত্যুক্তি করা হবে। এ কথাও সত্যের অনুরোধে বলা উচিত যে, এইরকমের নীেকো যদি গড়া হয় তা হলে ইনসুয়োরেন্স আপিস কিছুতেই তার দায়িত্ব নিতে রাজি হবে না। চলল রচনা, আকাশের চিত্রীও যা-খুশি তাই করছেন, আর ঘরের মধ্যে ঐ মস্ত-চোখ-মেলা ছেলেটিও তথৈবচ | J এদের খেয়াল ছিল না যে, দরজা খোলা । বড়োবাবু এলেন । গর্জন করে উঠলেন, “কী হচ্ছে রে ।” ছেলেটার বুক কেঁপে উঠল, মুখ হল ফ্যাকাশে । ছবি কোথায় লুকোবে তার জায়গা পায় না । বড়োবাবু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, পরীক্ষায় চুনিলালের ইতিহাসে তারিখ ভুল হচ্ছে তার কারণটা কোথায় । ইতিমধ্যে চুনিলাল ছবিটাকে তার জামার মধ্যে লুকোবার ব্যর্থ প্ৰয়াস করাতে অপরাধ আরো প্ৰকাশমান হয়ে উঠল । টেনে নিয়ে গোবিন্দ যা দেখলেন তাতে তিনি আরো অবাক- এটা ব্যাপারখানা কী । এর চেয়ে যে ইতিহাসের তারিখ ভুলও ভালো । ছবিটা কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেললেন । চুনিলাল ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল । সত্যবতী একাদশীর দিন প্ৰায় ঠাকুরঘরেই কাটাতেন। সেইখান থেকে ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলেন । ছবির ছিন্ন খণ্ডগুলো মেঝের উপর লুটােচ্ছে আর মেঝের উপর লুটােচ্ছে চুনিলাল। গোবিন্দ তখন ইতিহাসের তারিখ-ভুলের আদি কারণগুলো সংগ্ৰহ করছিলেন অপসারণের অভিপ্ৰায়ে । সত্যবতী এতদিন কখনো গোবিন্দর কোনো ব্যবহারে কোনো কথা বলেন নি । ঐরই ‘পরে তার স্বামী নির্ভর স্থাপন করেছেন, এই স্মরণ করেই তিনি নিঃশব্দে সব সহ্য করেছেন । আজ তিনি অশ্রুতে আর্দ্র, ক্ৰোধে কম্পিত কণ্ঠে বললেন, “কেন তুমি চুনির ছবি ছিড়ে ফেললে।” গোবিন্দ বললেন, “পড়াশুনো করবে না ? আখেরে ওর হবে কী ।” সত্যবতী বললেন, “আখেরে ও যদি পথের ভিক্ষুক হয় সেও ভালো । কিন্তু, কোনোদিন তোমার মতো যেন না হয় । ভগবান ওকে যে-সম্পদ দিয়েছেন তারই গৌরব যেন তোমার পয়সার গর্বের চেয়ে বেশি হয়, এই ওর প্রতি আমার, মায়ের আশীর্বাদ ।” গোবিন্দ বললেন, “আমার দায়িত্ব আমি ছাড়তে পারব না, এ চলবে না কিছুতেই। আমি কালই ওকে বাের্ডিং-স্কুলে পাঠিয়ে দেব— নইলে তুমি ওর সর্বনাশ করবে।” বড়োবাবু আপিসে গেলেন। ঘনবৃষ্টি নামল, রাস্তা জলে ভেসে যাচ্ছে। সত্যবতী চুনির হাত ধরে বললেন, “চল, বাবা।” চুনি বললে, “কোথায় যাবে, মা ।” Տ Հ | | Տ Գ