পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী "ל צ:) সাহিত্যসমালোচনা আমার দুটি কথা বলবার আছে। এক, আমরা গেল বারে যে আলোচনা করেছি। তার একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে।” সে রিপোর্ট যথাযথ হয় নি। অনেকদিন এ সম্বন্ধে দুঃখ বোধ করেছি, কখনো কোনো ? রিপোর্ট ঠিকমত পাই নি । সেদিন নানা আলোচনার ভিতর সব কথা ঠিক ধরা পড়েছে কি না জানি নে। আর-একটা বিপদ আছে, কোনো-কিছু সম্বন্ধে যখন যে-কেউ রিপোর্ট নিতে ইচ্ছা করেন তার নিজের মতামত খানিকটা সেটাকে বিচলিত করে থাকে । এটুকু জানিয়ে রাখছি যে, যদি এ সম্বন্ধে রিপোর্ট বেরোয় আমাকে দেখিয়ে নিলে ভালো হয় । তারও প্রয়োজন নেই, একটু সংযতভাবে চিত্তকে স্থির রেখে যদি লেখেন । এর দরকার আছে কেননা এ সম্বন্ধে এখনো উত্তেজনা আছে- সেজন্য অল্পমাত্র যদি বিকৃতি ঘটে তা হলে অন্যায় হবে। দ্বিতীয় কথা, আমি সতর্ক করতে চাই, ব্যক্তিগতভাবে এই তর্কে আমার কোনো স্থান নাই । এমন কথা নয় যে, আমি এক পক্ষে আছি, আর আধুনিক সাহিত্য আর-এক পক্ষে আছে। এরকম ভাবে তর্ক উঠলে আমি কুষ্ঠিত হব । বর্তমান কালে আমার লেখা মুখরোচক হােক বা না-হােক, আমি কিছুমাত্র আক্ষেপ করি নে। লোকমতের কী মূল্য আজকের দিনে আমার বুঝবার মতো বয়স হয়েছে। অল্প বয়স যখন ছিল তখন অবশ্য বুঝি নি, তখন লোকমতকে অত্যন্ত বেশি মূল্য দিতাম। অন্যের মত-অনুযায়ী লিখতে পারলে, অন্যকে অনুকরণ করতে পারলে, সত্য কাজ কিছু করা গেল। কল্পনা করেছি-- সে যে কত বড়ো অসত্য, বার বার, হাজার বার তা প্ৰমাণ হয়ে গেছে আমার এই জীবনে । আমি তার উপর বিশেষ কোনো আস্থা রাখি না। আমাকে কেউ পছন্দ করুন, বা না-করুন, এখন আমার চেয়ে ভালো লিখতে পারুন বা না-পারুন, সে আলোচনা অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি । আমি সেদিন যে-আলোচনা উত্থাপিত করেছিলাম সে-প্রসঙ্গে আমার মত আমি ব্যক্ত করেছি । সাহিত্যের মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে, নীতি সম্বন্ধে, যা বক্তব্য সে আমার লেখায় বারবার বলেছি। গত বারে সে কথা কিছু কিছু আলোচিত হয়েছে। এখনকার ধারা তরুণ সাহিত্যিক তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আমি কেন তাদের বিরুদ্ধে লিখেছিলাম কিংবা তাদের মতের প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি জানি, আমি কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উপলক্ষ করে লিখি নি । কতকগুলি লেখা আমার চোখে পড়েছিল যেগুলিকে সাহিত্যধর্ম-বিগাহিত মনে হয়েছিল । তাতে সমাজধর্মের যদি কোনো ক্ষতি করে থাকে, সমাজরক্ষার ব্ৰত যারা নিয়েছেন তারা সে-বিষয়ে চিন্তা করবেন ; আমি সে দিক থেকে কখনো আলোচনা করি নি । আমি দেখাবার চেষ্টা করেছি, মানুষ যে-সকল মনের সৃষ্টিকে চিরন্তন মূল্য দিয়ে থাকে, চিরকাল রক্ষা করবার যোগ্য ও গৌরবের বিষয় বলে মনে করে, তাকে সাহিত্যে এবং আর্টে চিরকালের ভাষায়, চিরকালের চিত্রে চিত্রিত করে । আমাদের সব সাহিত্যের গোড়াতেই যে-মহাকাব্য, স্পষ্টই দেখি, তার লক্ষ্য মানুষের দৈন্য প্রচার, মানুষের লজ্জা ঘোষণা করা নয়- তার মাহাত্ম্য স্বীকার করা । সংসারধর্মে মানবচরিত্রে সত্যের সেই সব প্রকাশকে তারা চিরকালের মূল্য দিয়েছেন, যাকে তঁরা সর্বকাল ও সর্বজনের কাছে ব্যক্ত করবার ও রক্ষা করবার যোগ্য মনে করেছেন । যার মধ্যে তারা সৌন্দৰ্য দেখেছেন, মহিমা দেখেছেন, তাই তাদের রচনার আনন্দকে জাগিয়েছে। বাল্মীকি যেদিন ছন্দ পেলেন সেদিন অনুভব করলেন, এ ছন্দ কোনো মহৎ চরিত্র, কোনো পরম অনুভূতি প্ৰকাশ করবার জন্যে, এমন কিছু যাতে মানবজীবনের পূর্ণতা, যাতে তার গীেরব । এর থেকে আমরা বুঝতে পারি, তখনকার লোক মনুষ্যত্বের কোন রূপকে শ্রেষ্ঠ বলে জানতেন । কলাবান বাক্য যে-বিষয়কে প্রকাশ করে তাকে আপনি অলংকারের দ্বারা স্থায়ী মূল্য দেয়। সেকালের কবি খুব প্ৰকাণ্ড পটের উপর খুব বড়ো ছবি এঁকেছেন এবং তাতে মানুষকে বড়ো দেখে মানুষ আনন্দ পেয়েছে। আমাদের মনের ভিতর ১ বাংলার কথা । ৬ চৈত্র, সোমবার, ১৩৩৪