পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Good রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী দেশের অত্যন্ত আধুনিক ছেলের পক্ষেও তাহা কঠিন হয় । আমাদের এই স্বভাব সম্বন্ধে পাঞ্জাবের লাটের সঙ্গেও আমার মতের মিল আছে । কিন্তু এক-এক সময়ে এমন দুৰ্যোগ আসে যখন এই বাঙালির ছেলের মতো অত্যন্ত ভালোমানুষের কাছেও উচ্চতম সত্যের কথা অবজ্ঞাভাজন হইয়া উঠে । কেননা, রিপুর সংঘাতে রিপু জাগে, তখন প্ৰমত্ততার উপরে কল্যাণকে স্বীকার করা দুঃসাধ্য হয়। আমাদের আশ্রমে দুটি ছোটাে ছেলে আছে। তাদের অভিভাবকদের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল । বরাবর তারা এখানে থাকিবার খরচ জোগাইয়াছে। কিছুকাল হইল তাদের পরিবারের তিনজন পুরুষের একসঙ্গে অন্তরায়ণ হইয়াছে। এখন আশ্রমবাসের খরচ জোগানো ছেলে-দুটির পক্ষে অসম্ভব, আশ্রমে তাদের শিক্ষা ও আহারাদির ভার এখন আশ্রমকেই লইতে হইল। এই ছেলে-দুটি কেবল যে নিজের গ্লানি বহিতেছে তা নয়, তাদের মায়ের যে দুঃখ কত তা তারা জানে । যে ব্যথায় অভাবে ও নিরানন্দে তাদের ঘর ভরিয়া উঠিয়াছে তা তাদের অগোচর নাই। ব্যাপকে ম্যালেরিয়ায় ধরিয়াছে, মা ব্যাকুল হইয়া চেষ্টা করিতেছেন যাতে তাকে স্বাস্থ্যকর জায়গায় বন্দী রাখা হয়, এই-সমস্ত দুশ্চিন্তার দুঃখ এই শিশু-দুটিকেও পীড়া দিতেছে। এ সম্বন্ধে ছেলে-দুটির মুখে একটি শব্দ নাই, আমরাও কিছু বলি নাকিন্তু এই ছেলেরা যখন সামনে থাকে তখন ধৈর্যের কথা, প্রেমের কথা, নিত্যধর্মের প্রতি নিষ্ঠার কথা, সর্বমানবের ভগবানের প্রতি বিশ্বাসের কথা বলিতে আমার কুষ্ঠা বোধ হয়, তখন সেই-সকল লোকের মুখ আমার মনে পড়ে যারা পাঞ্জাবের লাটের মতোই সাত্ত্বিকতার অতিশৈত্যকে পরিহাস করেন । এমনি করিয়া রিপুর সহিত রিপুর চকমকি ঠোকায় আগুন জ্বলিতেছে ; এমনি করিয়া বাংলাদেশের প্রদেশে প্রদেশে দুঃখে আতঙ্কে মানুষ বাহিরের খেদকে অন্তরের নিত্যভাণ্ডারে সঞ্চিত করিতেছে। শাসনকর্তার অদৃশ্য মেঘের ভিতর হইতে হঠাৎ সংসারের মাঝখানে যে-বোমাগুলা আসিয়া পড়িতেছে তাহাতে মরিতেছে বিস্তর অনাথ রমণী এবং অসহায় শিশু । ইহাদিগকে কি non-combatants fic r" | যদি জিজ্ঞাসা কর এই দুষ্ট সমস্যার মূল কোথায়, তবে বলিতেই হইবে স্বাধীন শাসনের অভাবে । ইংরেজের কাছে আমরা বড়োই পর, এমন-কি, চীন-জাপানের সঙ্গেও তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিক সমীপ্য অনুভব করেন, এ কথা তাদের কোনো কোনো বিদ্বান ভ্ৰমণকারী লিখিয়াছেন। তার পরে আমাদের আধ্যাত্মিকতা আছে, শুনিতেছি তাদের সে বালাই নাই— এত বড়ো মূলগত প্ৰভেদ মানুষে মানুষে আর-কিছু হইতেই পারে না । তার পরে তারা আমাদের ভাষা জানেন না, আমাদের সঙ্গ রাখেন না । যেখানে এত দূরত্ব, এত কম জানা, সেখানে সতর্ক সন্দিগ্ধতা একমাত্র পলিসি হইতে বাধ্য। সেখানে দেশের যে-সব লোক স্বার্থপর ও চতুর, যারা অবৈতনিক গুপ্তচরবৃত্তি তাহাকে মিথ্যায় এবং মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর অর্ধসত্যে ভরিয়া রাখে । যারা স্বার্থের চেয়ে আত্মসম্মানকে বড়ো জানে, যারা নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের মঙ্গলকে শ্রেয় বলিয়া জানে, তারা যতক্ষণ না পুলিসের গ্রাসে পড়ে ততক্ষণ এই শাসনব্যবস্থা হইতে যথাসম্ভব দূরে থাকে। এই নিয়ত পা টিপিয়া চলা এবং চুপি চুপি বলা, এই দিনরাত আড়ে আড়ে চাওয়া এবং ঝোপে-ঝাড়ে ঘোরা- আর কিছু নয়, এই যে অবিরত পুলিসের সঙ্গ করা- এই কলুষিত হাওয়ার মধ্যে যে-শাসনকর্তা বাস করেন তার মনের সন্দেহ কাজে নিদারুণ হইয়া উঠিতে কোনো স্বাভাবিক বাধা পায় না । কেননা, তাদের কাছে আমরা একটা অবচ্ছিন্ন সত্তা, আমরা কেবলমাত্র শাসিত সম্প্রদায় । সেইজন্য আমাদের ঘরে যখন মা কঁাদিতেছে, শ্ৰী আত্মহত্যা করিতেছে, শিশুদের শিক্ষা বন্ধ ; যখন ভাগ্যহীন দেশের বহু দুঃখের সৎচেষ্টাগুলি সি. আই. ডি.-র বাক্য ইশারামাত্রে চারি দিকে ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে ; তখন অপর পক্ষের কোনো মানুষের ডিনারের ক্ষুধা বা নিশীথনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে না এবং ব্রিজ-খেলাতেও উৎসাহ অক্ষুন্ন থাকে । ইহা দোষারোপ করিয়া বলিতেছি না, ইহা স্বাভাবিক । এই সব মানুষই যেখানে বোলোআন মানুষ, সেখানে আপিসের শুকনো পার্চমেন্টের নীচে হইতে তাদের হৃদয়টা সম্ভবত বাহির হইয়া থাকে। বুরোক্রেসি বলিতে সর্বত্রই সেই কর্তাদের বোঝায় যারা বিধাতার সৃষ্ট মনুষ্যলোক