পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর (2br& যখন পূরণ করতে চাই তখন মোহকে সহায় করতে ইচ্ছা হয়, তখন অক্ষমের লোভ আলাদিনের প্ৰদীপের গুজব শুনলেই একেবারে লাফিয়ে ওঠে । এ কথা সকলকেই একবাক্যে স্বীকার করতে হবে যে, আলাদিনের প্রদীপের মতো এমন আশ্চর্য সুবিধার জিনিস আর নেই, কেবল ওর একটি মাত্র অসুবিধা এই যে, ও জিনিস কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু পাওয়া যে যায় না। এ কথা খুব জোরের সঙ্গে সে মানুষ কিছুতেই বলতে পারে না। যার লোভ বেশি অথচ যার সামর্থ কম। এইজন্যে তার উদ্যম তখনই পুরোদমে জেগে ওঠে যখন তাকে কেউ আলাদিনের প্রদীপের আশ্বাস দিয়ে থাকে । সেই আশ্বাসকে হরণ করতে গেলে সে এমনি চিৎকার করতে থাকে যেন তার সর্বস্বাস্ত করা হল । সেই বঙ্গবিভাগের উত্তেজনার দিনে একদল যুবক রাষ্ট্রবিপ্লবের দ্বারা দেশে যুগান্তর আনবার উদ্যোগ করেছিলেন । আর যাই হোক, এই প্ৰলয়।হুতাশনে তারা নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন, এইজন্যে তারা কেবল আমাদের দেশে কেন সকল দেশেই সকলেরই নমস্যা । তাদের নিম্বফলতাও আত্মার দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। তারা পরমত্যাগে পরমদুঃখে আজ একটা কথা স্পষ্ট জেনেছেন যে, রাষ্ট্র যখন তৈরি নেই তখন রাষ্ট্রবিপ্লবের চেষ্টা করা পথ ছেড়ে অপথে চলা- পথের চেয়ে অপথ মাপে ছোটো, কিন্তু সেটাকে অনুসরণ করতে গেলে লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় না, মাঝের থেকে পা-দুটোকে কাটায় কাটায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয় । যে-জিনিসের যা দাম তা পুরো না দিতে পারলে দাম তো যায়ই জিনিসও জোটে না । সেদিনকার সেই দুঃসাহসিক যুবকেরা ভেবেছিলেন সমস্ত দেশের হয়ে তঁরা কয়জন আত্মোৎসর্গ দ্বারা রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটাবেন ; তাদের পক্ষে এটা সর্বনাশ, কিন্তু দেশের পক্ষে এটা সস্তা । সমস্ত দেশের অন্তঃকরণ থেকে সমস্ত দেশের উদ্ধার জেগে ওঠে, তার কোনো একটা অংশ থেকে নয় । রেলযানে ফাস্টক্লাস গাড়ির মূল্য এবং সৌষ্ঠব যেমনি থাক সে তার নিজের সঙ্গে সংযুক্ত থার্ড ক্লাস গাড়িকে কোনোমতেই এগিয়ে যেতে পারে না । আমার মনে হয় তারা আজ বুঝেছেন, সমগ্ৰ দেশ বলে একটি জিনিস সমস্ত দেশের লোকের সৃষ্টি ; এই সৃষ্টি তার সমস্ত হৃদয়বৃত্তি বুদ্ধিবৃত্তি ইচ্ছাশক্তির প্রকাশে । এ হচ্ছে যোগলব্ধ ধন, অর্থাৎ যে যোগের দ্বারা মানুষের সকল বৃত্তি আপন সৃষ্টির মধ্যে সংহত হয়ে রূপলাভ করে। পোলিটিকাল যোগ বা ইকনমিক যোগ পূর্ণ যোগ নয়, সর্বশক্তির যোগ চাই। অন্য দেশের ইতিহাস যখন লক্ষ্য করে দেখি তখন পােলিটিকাল ঘোড়াটাকে সকলের আগে দেখি, মনে মনে ঠিক করি ঐ চতুষ্পদটারই টানে সমস্ত জাত এগিয়ে চলেছে। তখন হিসাব করে দেখি নে, এর পিছনে দেশ ব’লে যে গাড়িটা আছে সেটা চলাবার যোগ্য গাড়ি, তার এক চাকার সঙ্গে আর-এক চাকার সামঞ্জস্য আছে, তার এক অংশের সঙ্গে আর-এক অংশের ভালোরকম জোড় মেলানো আছে । এই গাড়িটি তৈরি করে তুলতে শুধু আগুন এবং হাতুড়ি-করাত এবং কলকব্জা লেগেছে তা নয়, এর মধ্যে অনেক দিনের অনেক লোকের অনেক চিন্তা অনেক সাধনা অনেক ত্যাগ আছে । আরো এমন দেশ আমরা দেখেছি, সে বাহ্যত স্বাধীন, কিন্তু পোলিটিকাল বাহনটি যখন তাকে টানতে থাকে তখন তার ঝড়ঝড়, খড়খাড় শব্দে পাড়ার ঘুম ছুটে যায়, ঝাকানির চোটে সওয়ারির বুকে পিঠে খিল ধরতে থাকে, পথ চলতে চলতে দশবার করে সে ভেঙে ভেঙে পড়ে, দড়ি-দািড়া দিয়ে তাকে বাধতে বাধতে দিন কাবার হয়ে যায় । তবু ভালো হােক আর মন্দ হােক, স্কু আলগা হােক আর চাকা বঁকা হােক, এ গাড়িও গাড়ি, কিন্তু যে জিনিসটা ঘরে বাইরে সাত টুকরো হয়ে আছে, যার মধ্যে সমগ্ৰতা কেবল যে নেই তা নয়, যা বিরুদ্ধতায় ভরা, তাকে উপস্থিতমত ক্ৰোধ হােক বা লোভ হােক কোনো-একটা প্রবৃত্তির বাহবন্ধনে বেঁধে হেঁইহেঁই শব্দে টান দিলে কিছুক্ষণের জন্যে তাকে নড়ানো যায়- কিন্তু একে কি দেশদেবতার রথযাত্রা বলে । এই প্ৰবৃত্তির বন্ধন এবং টান কি টেকসই জিনিস। অতএব ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে আপাতত এই গড়াপেটার কাজটাই কি সব চেয়ে দরকার নয় । যমের ফাসি-বিভাগের সিংহদ্বার থেকে বাংলাদেশের যে-সব যুবক ঘরে ফিরে এসেছেন তাদের লেখা পড়ে কথা শুনে আমার মনে হয় তারা এই কথাই ভাবছেন । তারা বলছেন, সকলের আগে আমাদের যোগসাধন চাই, দেশের সমস্ত চিত্তবৃত্তির সম্মিলন ও পরিপূর্ণতা-সাধনের যোগ । বাইরের দিক থেকে কোনো অন্ধ বাধ্যতা দ্বারা এ হতেই পারে না, ভিতরের দিক থেকে জ্ঞানালোকিত চিত্তে আত্মোপলব্ধি দ্বারাই এ সম্ভব ।