পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOO রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাঙা-পা নিজের বলে চালাতে গেলে তার বিপদ আরো বাড়িয়ে ‘তুলতে পারে । ঐ-যে পূর্বেই বলেছি। একদা ইংরেজ-জাতের মধ্যে ভেদের যে ছিন্নতা ছিল সেটাকে একটা রাষ্ট্রনৈতিক সেলাইয়ের কল দিয়ে তারা পাকা করে জুড়েছে। কিন্তু যেখানে কাপড়টা তৈরিই হয় নি, সুতোগুলো কতক আলাদা হয়ে কতক জটা পাকিয়ে পড়ে আছে, সেখানে রাষ্ট্রনৈতিক সেলাইয়ের কলের কথা ভাবাই চলে না, সেখানে আরো গোড়ায় যেতে হয়, সেখানে সমাজনৈতিক তাতে চড়িয়ে বহু সুতেকে এক অখণ্ড কাপড়ে পরিণত করা চাই । তাতে বিলম্ব হবে, কিন্তু সেলাইয়ের কলে কিছুতেই বিলম্ব সারা যায় না । শিবঠাকুরের তিনটি বধু সম্বন্ধে ছড়ায় বলছে : এক কন্যে রাধেন বাড়েন, এক কন্যে খান, এক কন্যে না পেয়ে বাপের বাড়ি যান । তিন কন্যেরই আহারের সমান প্রয়োজন ছিল- কিন্তু দ্বিতীয় কন্যেটি যে সহজ উপায়ে আহার করেছিলেন, বিশেষ কারণে তৃতীয় কন্যের সেটা আয়ত্তাধীন ছিল না ; অতএব উদর এবং আহারসমস্যার পূরণ তিনি অপেক্ষাকৃত বিলম্বিত উপায়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন- বাপের বাড়ি ছুটেছিলেন । প্রথম কন্যের ক্ষুধানিবৃত্তি সম্বন্ধে পুরাবৃত্তের বিবরণটি অস্পষ্ট । আমার বিশ্বাস, তিনি আয়োজন মাত্র করেছিলেন, আর মধ্যমাটি তার ফলভোগ করে পরিতৃপ্ত হয়েছেন । ইতিহাসে এ-রকম দৃষ্টান্ত বিরল নয় । আমাদের এই জন্মভূমিটি শিবঠাকুরের মধ্যম প্ৰেয়সী নন, সে কথা ধরে নেওয়া যেতে পারে। বহু শতাব্দী ধরে বার বার তার পরিচয় পাওয়া গেল । কাজেই লক্ষ্যসিদ্ধি সম্বন্ধে মধ্যমার পথটি তার পথ হতেই পারে না । হয় তিনি রাধেন নি। অথচ ভোজের দাবি করেছেন, শেষে শিবঠাকুরের ধমক খেয়ে সনাতন বাপের বাড়ির দিকে চলতে চলতে বেলা বইয়ে দিয়েছেন- নয়তো রোধেছেন, বেড়েছেন, কিন্তু খাবার বেলায় দেখেছেন আর-একজন পাত শূন্য করে দিয়েছে। অতএব তার পক্ষে সমস্যা হচ্ছে, যে কারণে এমনটা ঘটে আর যে কারণে তিনি কথায় কথায় শিবঠাকুরকে চটিয়ে তোলেন সেটা সর্বাগ্রে দূর করে দেওয়া ; আবদার করে বললেই হবে না যে, মেজেবিউ যেমন করে খাচ্ছে। আমিও ঠিক তেমনি করে খাব ৷ আমরা সর্বদাই বলে থাকি, বিদেশী আমাদের রাজা,এই দুঃখ ঘুচালেই আমাদের সব দুঃখ ঘুচিবে । বিদেশী রাজা আমি পছন্দ করি নে। পেট-জোড়া পিলেও আমার পছন্দসই নয় । কিন্তু অনেকদিন থেকে দেখছি পিলেটি আমার সম্মতির অপেক্ষা না করে আপনি এসে পেট জুড়ে বসেছে। বহু যত্নে অন্তরের প্রকোষ্ঠে তাকে পালন করলেও বিপদ, আবার রাগের মাথায় ঘুষি মেরে তাকে ফাটিয়ে দিলেও সাংঘাতিক হয়ে ওঠে । যারা অভিজ্ঞ তারা বলেন, তোমাদের আশে-পাশে চার দিকেই ম্যালেরিয়া-বাহিনী ডোবা, সেইগুলো ভরাট না করলে তোমার পিলের ভরাট ছুটবে না । মুশকিলের ব্যাপার এই যে, পিলের উপরেই আমাদের যত রাগ, ডোবার উপরে নয় । আমরা বলি, আমাদের সনাতন ডোবা, ওগুলি যদি লুপ্ত হয় তা হলে ভূতকালের পবিত্র পদচিহ্নের গভীরতাই লোপ পাবে। সেই গভীরতা বর্তমানের অবিরল অশ্রুধারায় কানায় কানায় পূর্ণ হয় হােক। কিন্তু আমাদের লোকালয় চিরদিন যেন ডোবায় ডোবায় শতধা হয়ে থাকে । পাঠকেরা অধৈৰ্য হয়ে বলবেন, আর ভূমিকা নয়, এখন আমাদের বিশেষ সমস্যাটা কী বলেই ফেলো । বলতে সংকোচ হচ্ছে ; কারণ, কথাটা অত্যন্ত বেশি সহজ । শুনে সবাই অশ্রদ্ধা করে বলবেন, ও তো সবাই জানে। এইজন্যেই রোগের পরিচয় সম্বন্ধে ডাক্তারবাবু অনিদ্ৰা না বলে যদি ইনসমনিয়া বলেন, তা হলে মনে হয় তাকে ষোলো টাকা ফি দেওয়া ষোলো-আনা সার্থক হল । আসল কথা, আমরা এক নই, আমাদের নিজেদের মধ্যে ভেদের অন্ত নেই। প্ৰথমেই বলেছি- ভেদটাই দুঃখ, ঐটেই পাপ । সে ভেদ বিদেশীর সঙ্গেই হােক আর স্বদেশীর সঙ্গেই হােক । সমাজটাকে একটা ভেদবিহীন বৃহৎ দেহের মতো ব্যবহার করতে পারি। কখন । যখন তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে