পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

We SR 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রথম যুগে একদিন পৃথিবী আপনি তপ্ত নিশ্বাসের কুয়াশায় অবগুষ্ঠিত ছিল, তখন বিরাট আকাশের গ্রহমণ্ডলীর মধ্যে আপন স্থান সে উপলব্ধি করতেই পারে নি। অবশেষে একদিন তার মধ্যে সূর্যকিরণ প্রবেশের পথ পেল। তখনই সেই মুক্তিতে আরম্ভ হল পৃথিবীর গৌরবের যুগ । তেমনিই একদিন আর্দ্র হৃদয়ালুতার ঘন বাষ্পবরণ আমাদের মেয়েদের চিত্তকে অত্যন্ত কাছের সংসারে আবিষ্ট করে রেখেছিল । আজ তা ভেদ করে সেই আলোকরশ্মি প্রবেশ করছে যা মুক্ত আকাশের, যা সর্বলোকের । বহু দিনের যে-সব সংস্কারজড়িমাজালে তাদের চিত্ত আবদ্ধ বিজড়িত ছিল যদিও আজ তা সম্পূর্ণ কেটে যায় নি, তবু তার মধ্যে অনেকখানি ছেদ ঘটেছে। কতখানি যে, তা আমাদের মতো প্রাচীন বয়স যাদের তারাই জানে । আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মেয়েরা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন এই বৃহৎ সংসারের দায়িত্ব তাদের স্বীকার করতেই হবে ; নইলে তাদের লজ্জা, তাদের অকৃতাৰ্থতা । আমার মনে হয়, পৃথিবীতে নূতন যুগ এসেছে। অতিদীর্ঘকাল মানবসভ্যতার ব্যবস্থাভার ছিল। পুরুষের হাতে । এই সভ্যতার রাষ্ট্ৰতন্ত্র অর্থনীতি সমাজশাসনতন্ত্র গড়েছিল পুরুষ । মেয়েরা তার পিছনে প্ৰকাশহীন। অন্তরালে থেকে কেবল করেছিল। ঘরের কাজ । এই সভ্যতা হয়েছিল একক্টোকা । এই সভ্যতায় মানবচিত্তের অনেকটা সম্পদের অভাব ঘটেছে ; সেই সম্পদ মেয়েদের হৃদয়ভাণ্ডারে কৃপণের জিম্মায় আটকা পড়ে ছিল। আজ ভাণ্ডারের দ্বার খুলেছে। তরুণ যুগের মানুষহীন পৃথিবীতে পঞ্চস্তরের উপর যে অরণ্য ছিল বিস্তৃত সেই অরণ্য বহুলক্ষ বৎসর ধরে প্রতিদিন সূৰ্যতেজ সঞ্চয় করে এসেছে আপনি বৃক্ষরাজির মজ্জায় । সেই সব অরণ্য ভূগর্ভে তলিয়ে দিয়ে রূপান্তরিত অবস্থায় বহুযুগ প্রচ্ছন্ন ছিল । সেই পাতালের দ্বার যেদিন উদঘাটিত হল, অকস্মাৎ মানুষ শত শত বৎসরের অব্যবহৃত সূৰ্যতেজকে পাথুরে কয়লার আকারে লাভ করল। আপন কাজে ; তখনই নুতন বল নিয়ে বিশ্ববিজয়ী আধুনিক যুগ দেখা দিল । একদিন এ যেমন ঘটেছে সভ্যতার বাহিরের সম্পদ নিয়ে, আজ তেমনি অন্তরের সম্পদের একটি বিশেষ খনিও আপনি সঞ্চয়কে বাহিরে প্রকাশ করল । ঘরের মেয়েরা প্ৰতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই উপলক্ষে মানুষের সৃষ্টিশীল চিত্তে এই-যে নূতন চিত্তের যোগ, সভ্যতায় এ আর-একটি তেজ এনে দিলে। আজ এর ক্রিয়া প্রত্যক্ষে অপ্রত্যক্ষে চলছে। এক পুরুষের গড়া সভ্যতায় যে ভারসামঞ্জস্যের অভাব প্ৰায়ই প্ৰলয় বাধাবার লক্ষণ আনে, আজি আশা করা যায় ক্ৰমে সে যাবে সাম্যের দিকে। প্রচণ্ড ভূমিকম্প বার বার ধাক্কা লাগাচ্ছে পুরাতন সভ্যতার ভিত্তিতে। এই সভ্যতায় বিপত্তির কারণ অনেক দিন থেকে সঞ্চিত হয়ে উঠছিল, অতএব ভাঙনের কাজ কেউ বন্ধ করতে পারবে না। একটিমাত্র বড়ো আশ্বাসের কথা এই যে, কল্পাস্তের ভূমিকায় নূতন সভ্যতা গড়বার কাজে মেয়েরা এসে দাড়িয়েছে- প্ৰস্তুত হচ্ছে তারা পৃথিবীর সর্বত্রই । তাদের মুখের উপর থেকেই যে কেবল ঘোমটা খসল তা নয়- যে ঘোমটার আবরণে তারা অধিকাংশ জগতের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। সেই মনের ঘোমটাও তাদের খসছে । যে মানবসমাজে তারা জন্মেছে সেই সমাজ আজ সকল দিকেই সকল বিভাগেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠল তাদের দৃষ্টির সম্মুখে । এখন অন্ধসংস্কারের কারখানায় গড়া পুতুলগুলো নিয়ে খেলা করা আর তাদের সাজবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবপালিনী বুদ্ধি, কেবল ঘরের লোককে নয়, সকল লোককে রক্ষার জন্যে কায়মনে প্ৰবৃত্ত হবে । আদিকাল থেকে পুরুষ আপন সভ্যতাদুর্গের ইটগুলো তৈরি করেছে নিরন্তর নরবলির রক্তেতারা নির্মমভাবে কেবলই ব্যক্তিবিশেষকে মেরেছে কোনো একটা সাধারণ নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে ; ধনিকের ধন উৎপন্ন হয়েছে শ্রমিকের প্রাণ শোষণ করে ; প্ৰতাপশালীর প্রতাপের আগুন জ্বালানো রয়েছে অসংখ্য দুর্বলের রক্তের আহুতি দিয়ে ; রাষ্ট্রস্বার্থের রথ চালিয়েছে প্রজাদের তাতে রজ্জ্ববিদ্ধ করে । এ সভ্যতা ক্ষমতার দ্বারা চালিত, এতে মমতার স্থান অল্প। শিকারের আমোদকে জয়যুক্ত করে এ সভ্যতা বধ করে এসেছে অসংখ্য নিরীহ নিরুপায় প্রাণী ; এ সভ্যতায় জীবজগতে মানুষকে সকলের