পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Հ Գ Ե- রবীন্দ্র-রচনাবলী বেড়াচ্ছে— তাকে আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি নে। আসল কথা, আমার চারি দিকে আমি একটি সৌন্দর্যের সামঞ্জস্য দেখতে চাই— জীবনটি বেশ একটি অখণ্ড রাগিণীর মতো হবে, তবে আমার মধ্যে যা-কিছু পদার্থ আছে তা ভালো করে প্রকাশ পাবে। কিন্তু আমার এই নতুন স্ত্রীর সঙ্গে আমার পুরোনো অবস্থার ঠিক সুর মেলাতে পারছি নে, আমার কোনো জিনিস তাকে কেমন খাপ খাচ্ছে না, আর তাই ক্রমাগত আমাকে ছুচের মতো বিধছে। থাকত। যদি আরব্য-উপন্যাসের একটি পোষা দৈত্য, স্ত্রী ঘরে পদার্পণ করলেন আমনি একটি কিংকরী সোনার থালে হ্যামিল্টনের দোকানের সমস্ত ভালো ভালো গয়না এনে তার পায়ের কাছে রেখে গেল, দু-জন দাসী বসবার ঘরে মছলন্দ বিছিয়ে চামৱ হাতে করে দুই দিকে দাঁড়াল, চারি দিক থেকে সংগীত উঠছে, বাগান থেকে ফুলের গন্ধ আসছে— যেদিকে চোখ পড়ছে তক তক ঝক ঝক করছে— সে হলে একরকম হত- আর এই এক জীৰ্ণ ঘরে ছেড়া মাদুরে উঠতে-বসতে লজ্জিত হয়ে আছি। যা বলিস ভাই, স্ত্রীর কাছে মান রাখতে সকলেরই সাধ যায়, এমন-কি, সেইজন্যে মনু বলে গেছেন স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলতে পাপ নেই। তা ভাই, মিথ্যা কথা দিয়ে যদি আমার পটলডাঙার বাসাটা ঢেকে ফেলতে পারতুম, আমার বর্তমান অবস্থা আগাগোড়া গিলটি করে দিতে পারতুম, তা হলে মিথ্যে আমার মুখে বাধত না— কিন্তু এতখানি ছেড়া বেরিয়ে পড়ছে যে কেবল কথা দিয়ে আর রিফু চলে না। এখন এ অবস্থায় সে কি আমাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করতে পারে। আমার মধ্যে যেটুকু পদার্থ আছে সে কি আমি তার কাছে প্ৰকাশ করতে পেরেছি। আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই সে আমাকে কী হীনতার মধ্যে দেখছে বলে দেখি। তুমি কি বল এ অবস্থায় মানুষের বসে বসে প্ৰেমালাপ করতে শখ যায়। এই তো ভাই, আমার যেরকম স্বভাব তা খুলে বললুম, খুব যে উচুদরের বীরত্বময় মহত্ত্বপূর্ণ তা নয়— কিন্তু উচু নিচু মাঝারি এই তিন রকমেরই মানুষ আছে, ওর মধ্যে আমাকে যে দলেই ফেল আমার আপত্তি নেই— কিন্তু ভুল বুঝে না | চন্দ্ৰকান্ত। তোমার সঙ্গে বক্তৃতায় কে পারবে বলো। যা হােক, এখন কর্তব্য কী বলো দেখি। বিনোদবিহারী। আমি তাকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। চন্দ্ৰকান্ত। তুমি নিজে চেষ্টা করে ? না তিনি রাগ করে গেছেন ? বিনোদবিহারী। না, আমি তাকে একরকম বুঝিয়ে দিলুম— চন্দ্ৰকান্ত। যে, এখানে তিনি টিকতে পারবেন না! তুমি সব পাের। যদি বন্ধুত্ব রাখতে চাও তো ও-আলোচনায় আর কােজ নেই, তোমার যা কর্তব্য বোধ হয় তুমি কোরো। নিমাই ভাই, তোমার সে কথাটা মনে রইল— আগে একবার নিজের শ্বশুরবাড়িটা ঘুরে আসি, তার পরে বেশ উৎসাহের সঙ্গে কাজটায় লাগতে পারব। বিনু, আজ আমার মনটা কিছু অস্থির আছে, আজ আর থাকতে পারছি নে-- কাল তোমার বাসায় একবার যাওয়া যাবে | [প্ৰস্তান নলিনাক্ষ। চলো ভাই বিনু, আমরা দুজনে মিলে গোলদিঘির ধারে বেড়াতে যাই গে। বিনোদবিহারী। আমার এখন গোলদিঘি বেড়াবার শখ নেই নলিন। সেখানে যখন যাব একেবারে দড়ি-কলসি হাতে করে নিয়ে যাব । নলিনাক্ষ। কেন ভাই, অনৰ্থক তুমি ওরকম মন খারাপ করে রয়েছ ? একে তো এই পোড়া সংসারে যথেষ্ট অসুখ আছে তার পরে আবার— বিনোদবিহারী। বন্ধু লাগলে আরো অসহ্য হয়ে ওঠে। নলিনাক্ষ। কী করলে তোমার দগ্ধ হৃদয়ে আমি একটুখানি সান্তুনা দিতে পারি ভাই। বিনোদবিহারী । নলিন, তোর দুটি পায়ে পড়ি আমাকে সাস্তুনা দেবার জন্যে এত অবিশ্রাম চেষ্টা করিস নে, মাঝে মাঝে একটু একটু হাপি ছাড়তে দিস।। নলিনাক্ষ। তুমি এখন কোথায় যােচ্ছ। বিনোদবিহারী। বাড়ি যাচ্ছি।