পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○ じ রবীন্দ্র-রচনাবলী রাত্রে আশা মহেন্দ্রের নিকটে বিহারী সম্বন্ধে রাগ প্ৰকাশ করিল- মহেন্দ্ৰ অন্য দিনের মতো হাসিয়া উড়াইয়া দিল না— সম্পূর্ণ যোগ দিল। প্ৰাতঃকালে উঠিয়াই মহেন্দ্ৰ বিহারীর বাড়ি গেল। কহিল, “বিহারী, বিনোদিনী হাজার হউক ঠিক বাড়ির মেয়ে নয়- তুমি সামনে আসিলে সে যেন কিছু বিরক্ত হয়।” বিহারী কহিল, “তাই নাকি । তবে কাজটা ভালো হয় না। তিনি যদি আপত্তি করেন, তার সামনে নাই গেলাম।” মহেন্দ্ৰ নিশ্চিন্ত হইল। এত সহজে এই অপ্ৰিয় কার্য শেষ হইবে, তাহা সে মনে করে নাই । বিহারীকে মহেন্দ্ৰ ভয় করে। সেইদিনই বিহারী মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে গিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, মাপ করিতে হইবে।” বিনোদিনী। কেন, বিহারীবাবু। বিহারী। মহেন্দ্রের কাছে শুনিলাম, আমি অন্তঃপুরে আপনার সামনে বাহির হই বলিয়া আপনি বিরক্ত হইয়াছেন। তাই ক্ষমা চাহিয়া বিদায় হইব । বিনোদিনী। সে কি হয়, বিহারীবাবু। আমি আজ আছি কাল নাই, আপনি আমার জন্যে কেন যাইবেন। এত গোল হইবে জানিলে আমি এখানে আসিতাম না । এই বলিয়া বিনোদিনী মুখ স্নান করিয়া যেন অশ্রুসংবরণ করিতে দ্রুততপদে চলিয়া গেল। বিহারী ক্ষণকালের জন্যে মনে করিল, “মিথ্যা সন্দেহ করিয়া আমি বিনোদিনীকে অন্যায় আঘাত করিয়াছি।” সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজলক্ষ্মী বিপন্নভাবে আসিয়া কহিলেন, “মহিন, বিপিনের বউ যে বাড়ি মহেন্দ্ৰ কহিল, “কোন মা, এখানে তার কি অসুবিধা হইতেছে।” রাজলক্ষ্মী। অসুবিধা না। বউ বলিতেছে, তাহার মতো সমর্থবয়সের বিধবা মেয়ে পরের বাড়ি বেশি দিন থাকিলে লোকে নিন্দা করিবে । মহেন্দ্ৰ ক্ষুব্ধভাবে কহিল, “এ বুঝি পরের বাড়ি হইল ?” বিহারী বসিয়া ছিল— মহেন্দ্ৰ তাহার প্রতি ভৎসনাদৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। অনুতপ্ত বিহারী ভাবিল, “কাল আমার কথাবার্তায় একটু যেন নিন্দার আভাস ছিল ; বিনোদিনী বোধ হয় তাহাতেই বেদনা পাইয়াছে।” স্বামী স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া বিনোদিনীর উপর অভিমান করিয়া বসিল । ইনি বলিলেন, “আমাদের পর মনে কর, ভাই!” উনি বলিলেন, “এতদিন পরে আমরা পর হইলাম!” বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কি তোমরা চিরকাল ধরিয়া রাখিবে, ভাই।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “এত কি আমাদের স্পর্ধা।” আশা কহিল, “তবে কেন এমন করিয়া আমাদের মন কড়িয়া লইলে ।” সেদিন কিছুই স্থির হইল না। বিনোদিনী কহিল, “না ভাই, কাজ নাই, দুদিনের জন্য মায়া না বাড়ানোই ভালো।” বলিয়া ব্যাকুলচক্ষে একবার মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। পরদিন বিহারী আসিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, যাবার কথা কেন বলিতেছেন। কিছু দোষ করিয়াছি কি- তাহারই শাস্তি ?” বিনোদিনী একটু মুখ ফিরাইয়া কহিল, “দোষ আপনি কেন করিবেন, আমার অদৃষ্টের দোষ।” বিহারী। আপনি যদি চলিয়া যান তো আমার কেবলই মনে হইবে, আমারই উপর রাগ করিয়া C°iC፰ቫማ | বিনোদিনী করুণাচক্ষে মিনতি প্ৰকাশ করিয়া বিহারীর মুখের দিকে চাহিল— কহিল, “আমার কি থাকা উচিত হয়, আপনিই বলুন-না।”