পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(& CO NA রবীন্দ্র-রচনাবলী Ο Σ হিমালয়শিখর যে যমুনাকে তুষারাস্ত্ৰত অক্ষয় জলধাবা দিতেছে, কতকালের কবিরা মিলিয়া সেই যমুনার মধ্যে যে কবিত্বস্রোত ঢালিয়াছেন, তাহাও অক্ষয়। ইহার কলধ্বনির মধ্যে কত বিচিত্ৰ ছন্দ ধবনিত এবং ইহার তরঙ্গলীলায় কতকালের পুলকোচ্ছসিত ভাবাবেগ উদবেলিত হইয়া উঠিতেছে! প্রদোষে সেই যমুনাতীরে মহেন্দ্ৰ আসিয়া যখন বসিল, তখন ঘনীভূত প্রেমের আবেশ তাহার দৃষ্টিতে, তাহার নিশ্বাসে, তাহার শিরায়, তাহার অস্থিগুলির মধ্যে প্রগাঢ় মোহরাসপ্রবাহ সঞ্চার করিয়া দিল। আকাশে সূর্যস্তকিরণের স্বর্ণবীণা বেদনার মূৰ্ছিনায় আলোকশ্রুত সংগীতে ঝংকৃত হইয়া উঠিল! বিস্তীর্ণ নির্জন বালুতটে বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় দিন ধীরে ধীরে অবসান হইয়া গেল। মহেন্দ্র চক্ষু অর্ধেক মুদ্রিত করিয়া কাব্যলোক হইতে গোখুর-ধূলিজালের মধ্যে বৃন্দাবনের ধেনুদের গোষ্ঠে প্রত্যাবর্তনের হাম্বারব শুনিতে পাইল । বর্ষার মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হইয়া আসিল । অপরিচিত স্থানের অন্ধকার কেবল কৃষ্ণবর্ণের আবরণ মাত্র নহে, তাহা বিচিত্র রহস্যে পরিপূর্ণ। তাহার মধ্য দিয়া যেটুকু আভা যেটুকু আকৃতি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা অজ্ঞাত অনুচ্চারিত ভাষায় কথা কহে । পরপরবর্তী বালুকার অস্ফুট পাণ্ডুরতা, নিস্তরঙ্গ জলের মসীকৃষ্ণ কালিমা, বাগানে ঘনপল্লব বিপুল নিম্ববৃক্ষের পুঞ্জীভূত স্তব্ধতা, তরুহীন স্নান ধূসর তটের বঙ্কিম রেখা, সমস্ত সেই আষাঢ়-সন্ধ্যার অন্ধকারে বিবিধ অনির্দিষ্ট অপরিস্ফুট আকারে মিলিত হইয়া মহেন্দ্ৰকে চারি দিকে বেষ্টন করিয়া ধরিল। পদাবলীর বর্ষাভিসার মহেন্দ্রের মনে পড়িল । অভিসারিকা বাহির হইয়াছে। যমুনার ঐ তটপ্ৰান্তে সে একাকিনী আসিয়া দাড়াইয়াছে। পার হইবে কেমন করিয়া । ‘ওগো পার করো গো, পার করো’- মহেন্দ্রের বুকের মধ্যে এই ডাক আসিয়া পৌছিতেছে- ‘ওগো, পার করো।” নদীর পরপারে অন্ধকারে সেই অভিসারিণী বহুদূরে-– তবু মহেন্দ্ৰ তাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইল । তাহার কাল নাই তাহার বয়স নাই, সে চিরন্তন গোপবালা— কিন্তু তবু মহেন্দ্ৰ তাহাকে চিনিল— সে এই বিনোদিনী ! সমস্ত বিরহ, সমস্ত বেদনা, সমস্ত যৌবনভার লইয়া তখনকার কাল হইতে সে অভিসারে যাত্ৰা করিয়া, কত গান কত ছন্দের মধ্য দিয়া এখনকার কালের তীরে আসিয়া উত্তীৰ্ণ হইয়াছে— আজিকার এই জনহীন যমুনাতটের উপরকার আকাশে তাহারই কণ্ঠস্বর শুনা যাইতেছে- ‘ওগো, পার করো গো”— খেয়া-নৌকার জন্য সে এই অন্ধকারে আর কতকাল এমন একলা দাড়াইয়া থাকিবে— ‘ওগো, পার করো।” মেঘের এক প্রান্ত অপসারিত হইয়া কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার চাদ দেখা দিল। জ্যোৎস্নার, মায়ামস্ত্রে সেই নদী ও নদীতীর, সেই আকাশ ও আকাশের সীমান্ত, পৃথিবীর অনেক বাহিরে চলিয়া গেল। মর্তের কোনো বন্ধন রহিল না। কালের সমস্ত ধারাবাহিকতা ছিডিয়া গেল— অতীতকালের সমস্ত ইতিহাস লুপ্ত, ভবিষ্যৎ কালের সমস্ত ফলাফল অন্তহিঁত— শুধু এই রজতধারা-প্লাবিত বর্তমানটুকু যমুনা ও যমুনাতটের মধ্যে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীকে লইয়া বিশ্ববিধানের বাহিরে চিরস্থায়ী। মহেন্দ্ৰ মাতাল হইয়া উঠিল। বিনোদিনী যে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিবে, জ্যোৎস্নারাত্রির এই নির্জন স্বৰ্গখণ্ডকে লক্ষ্মীরূপে সম্পূৰ্ণ করিয়া তুলিবে না, ইহা সে কল্পনা করিতে পারিল না। তৎক্ষণাৎ উঠিয়া সে বিনোদিনীকে খুজিতে বাড়ির দিকে চলিয়া গেল। শয়নগৃহে আসিয়া দেখিল, ঘর ফুলের গন্ধে পূর্ণ। উন্মুক্ত জানালা-দরজা দিয়া জ্যোৎস্নার আলো শুভ্ৰ বিছানার উপর আসিয়া পড়িয়াছে। বিনোদিনী বাগান হইতে ফুল তুলিয়া মালা গাথিয়া খোপায় পরিয়াছে, গলায় পরিয়াছে, কটিতে বাধিয়াছে— ফুলে ভূষিত হইয়া সে বসন্তকালের পুষ্পভারলুষ্ঠিত লতাটির ন্যায় জ্যোৎস্নায় বিছানার উপরে পডিয়া আছে। মহেন্দ্রের মোহ দ্বিগুণ হইয়া উঠিল। সে অবরুদ্ধকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদ, আমি যমুনার ধারে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিলাম, তুমি যে এখানে অপেক্ষা করিয়া আছ, আকাশের চাদ আমাকে সেই