পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্ৰজাপতির নির্বন্ধ (8) পূর্ণ। অর্থাৎ, মনোহরণ এবং প্রাণহরণ দুই কর্মেই মজবুত হবে। পুরুষ দেবী-চৌধুরানীর দল আর-কি। শ্ৰীশ। বঙ্কিমবাবু আমার আইডিয়াটা পূর্বে হতেই চুরি করে রেখেছেন, কিন্তু ওটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নিজের করে নিতে হবে। পূর্ণ। সভাপতিমশায় কী বলেন ? শ্ৰীশ। তাকে কদিন ধরে বুঝিয়ে বুঝিয়ে আমার দলে টেনে নিয়েছি। কিন্তু তিনি তার দেশালাইয়ের কাঠি ছাড়েন নি। তিনি বলেন, সন্ন্যাসীরা কৃষিতত্ত্ব বস্তুতত্ত্ব প্রভৃতি শিখে গ্রামে গ্রামে চাষাদের শিখিয়ে বেড়াবে, এক টাকা করে শেয়ার নিয়ে একটা ব্যাঙ্ক খুলে বড়ো বড়ো পল্লীতে নূতন নিয়মে এক-একটা দোকান বসিয়ে আসবে— ভারতবর্ষের চারি দিকে বাণিজ্যের জাল বিস্তার করে দেবে। তিনি খুব মেতে উঠেছেন। পূর্ণ। বিপিনবাবুর কী মত ? বিপিনের মতে শ্ৰীশের এই কল্পনাটি কাৰ্যসাধ্য নয় ; কিন্তু শ্ৰীশের সর্বপ্রকার পাগলামিকে সে মেহের চক্ষে দেখিত, প্ৰতিবাদ করিয়া শ্ৰীশের উৎসাহে আঘাত দিতে তাহার কোনোমতেই মন সরিত না। সে বলিল, “যদিচ আমি নিজেকে শ্ৰীশের নবীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের আদর্শ পুরুষ বলে জ্ঞান করি নে, কিন্তু দল যদি গড়ে ওঠে তো আমিও সন্ন্যাসী সাজতে রাজি আছি।” পূর্ণ। কিন্তু সাজতে খরচ আছে মশায়। কেবল কীেপীন নয় তো— অঙ্গদ, কুণ্ডল, আভরণ, কুন্তলীন, দেলখোস— শ্ৰীশ। পূৰ্ণবাবু, ঠাট্টাই কর আর যাই কর, চিরকুমার-সভা সন্ন্যাসীসভা হবেই। আমরা এক দিকে কঠোর আত্মত্যাগ করব, অন্য দিকে মনুষ্যত্বের কোনো উপকরণ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করব না। আমরা কঠিন শৌর্য এবং ললিত সৌন্দর্য উভয়কেই সমান আদরে বরণ করব। সেই দুরূহ সাধনায় ভারতবর্ষে নবযুগের আবির্ভাব হবে— পূর্ণ। বুঝেছি। শ্ৰীশবাবু! কিন্তু নারী কি মনুষ্যত্বের একটা সর্বপ্রধান উপকরণের মধ্যে গণ্য নয় ? এবং তাকে উপেক্ষা করলে ললিত সৌন্দর্যের প্রতি কি সমাদর রক্ষা হবে ? তার কী উপায় করলে ? শ্ৰীশ । নারীর একটা দোষ নরজাতিকে তিনি লতার মতন বেষ্টন করে ধরেন, যদি তার দ্বারা বিজড়িত হবার আশঙ্কা না থাকত, যদি তাকে রক্ষা করেও স্বাধীনতা রক্ষা করা যেত, তা হলে কোনো কথা ছিল না। কাজে যখন জীবন উৎসর্গ করতে হবে তখন কাজের সমস্ত বাধা দূর করতে চাই। পাণিগ্রহণ করে ফেললে নিজের পাণিকেও বদ্ধ করে ফেলতে হবে, সে হলে চলবে না পূৰ্ণবাবু! পূর্ণ। ব্যস্ত হােয়ো না ভাই, আমি আমার শুভবিবাহে তোমাদের নিমন্ত্রণ করতে আসি নি। কিন্তু ভেবে দেখো দেখি, মনুষ্যজন্ম আর পাব কি না সন্দেহ — অথচ হৃদয়কে চিরজীবন যে পিপাসার জল থেকে বঞ্চিত করতে যাচ্ছি। তার পূরণস্বরূপ আর কোথাও আর কিছু জুটবে কি ? মুসলমানের স্বৰ্গে হুরি আছে, হিন্দুর স্বগোও অন্সরার অভাব নেই, চিরকুমার-সভার স্বগে সভাপতি এবং সভ্যমশায়দের চেয়ে মনোরম আর কিছু পাওয়া যাবে কি ! শ্ৰীশ। পূৰ্ণবাবু, বল কী ? তুমি যে— পূর্ণ। ভয় নেই ভাই, এখনো মরিয়া হয়ে উঠি নি। তোমার এই ছাদ-ভরা জ্যোৎস্না আর ঐ ফুলের গন্ধ কি কৌমাৰ্যব্রতরক্ষার সহায়তা করবার জন্যে সৃষ্টি হয়েছে ? মনের মধ্যে মাঝে মাঝে যে বাষ্প জমে আমি সেটাকে উচ্ছসিত করে দেওয়াই ভালো বোধ করি, চেপে রেখে নিজেকে ভোলাতে গেলে কোন দিন চিরকুমারব্রতের লোহার বয়লারখানা ফেটে যাবে। যাই হােক, যদি সন্ন্যাসী হওয়াই স্থির কর তো আমিও যোগ দেব, কিন্তু আপাতত সভাটাকে তো রক্ষা করতে হবে। শ্ৰীশ । কেন ? কী হয়েছে ? পূর্ণ। অক্ষয়বাবু আমাদের সভাকে যে স্থানান্তর করবার ব্যবস্থা করছেন এটা আমার ভালো