পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VoVo Sq রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রূপান্তরের মধ্যে নিজের ইতিহাস প্রত্যক্ষ নিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে তাহা তেমন করিয়া দেখি না। বলিয়াই ভাষারহস্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হইয়া উঠে না । এক ভারতবর্ষে সমাজ ও ধর্মের যেমন বহুতর অবস্থাবৈচিত্ৰ্য আছে, এমন বোধ হয়। আর কোনো দেশে নাই। অনুসন্ধানপূর্বক অভিনিবেশপূর্বক সেই বৈচিত্ৰ্য আলোচনা করিয়া দেখিলে সমাজ ও ধর্মের বিজ্ঞান আমাদের কাছে যেমন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিবে, এমন দূর দেশের ধর্ম ও সমাজ –সম্বন্ধীয় বই পড়িবামাত্র কখনো হইতে পারে না । ধারণা যখন অস্পষ্ট ও দুর্বল থাকে তখন উদ্ভাবনাশক্তির আশা করা যায় না। এমন-কি, তখনকার সমস্ত উদ্ভাবনা অবাস্তবিক অদ্ভুত আকার ধারণ করে। এইজন্যই আমরা কেতবে ইতিহাস শিখিয়াও ঐতিহাসিক বিচার তেমন করিয়া আয়ত্ত করিতে পারি নাই ; কেতবে বিজ্ঞান শিখিয়াও অভূতপূর্ব কাল্পনিকতাকে বিজ্ঞান বলিয়া চালাইয়া থাকি ; ধর্ম, সমাজ, এমন-কি, সাহিত্যসমালোচনাতেও অপ্ৰমত্ত পরিমাণবোধ রক্ষা করিতে পারি না । বাস্তবিকতাবিবর্জিত হইলে আমাদের মনই বলো, হৃদয়ই বলো, কল্পনাই বলো, কৃশ এবং বিকৃত হইয়া যায় । আমাদের দেশহিতৈষী ইহার প্রমাণ । দেশের লোকের হিতের সঙ্গে এই হিতৈষার যোগ নাই। দেশের লোক রোগে মরিতেছে, দারিদ্র্যে জীর্ণ হইতেছে, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় নষ্ট হইতেছে, ইহার প্রতিকারের জন্য যাহারা কিছুমাত্র নিজের চেষ্টা প্রয়োগ করিতে প্ৰবৃত্ত হয় না। তাহারা বিদেশী সাহিত্য-ইতিহাসের পুঁথিগত পেট্রিয়টিজম নানাপ্রকার অসংগত অনুকরণের দ্বারা লাভ করিয়াছি বলিয়া কল্পনা করে । এইজন্যই, এতকাল গেল, তথাপি এই পেট্রিয়টিজম আমাদিগকে যথার্থ কোনাে ত্যাগাস্বীকারে প্রবৃত্ত করিতে পারিল না । যে দেশে পেট্রিয়টিজম অবাস্তব নহে, পুঁথিগত অনুকরণমূলক নহে, সেখানকার লোক দেশের জন্য অনায়াসে প্ৰাণ দিতেছে ; আমরা সামান্য অর্থ দিতে পারি না, সময় দিতে পারি না, আমাদের দেশ যে কিরূপ তাহা সন্ধানপূর্বক জানিবার জন্য উৎসাহ অনুভব করি না । যোশিদা তোরাজিরো জাপানের একজন বিখ্যাত পেট্রিয়ট ছিলেন । তিনি তাহার প্রথমাবস্থায় চাল-চিড়া বাধিয়া পায়ে হাটিয়া ক্রমাগতই সমস্ত দেশ কেবল ভ্ৰমণ করিয়াই বেড়াইয়াছেন । এইরূপে দেশকে তন্ন তন্ন করিয়া জানিয়া তাহার পরে ছাত্র পড়াইবার কাজে নিযুক্ত হন— শেষব্দশায় তাহাকে দেশের কাজে প্ৰাণ দিতে হইয়াছিল। এইরূপ পেট্রিয়টিজমের অর্থ বোঝা যায়। দেশের বাস্তবিক জ্ঞান এবং দেশের বাস্তবিক কাজের উপরে যখন দেশহিতৈষী প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই তাহা মাটিতে বদ্ধমূল গাছের মতো ফল দিতে থাকে । অতএব এ কথা যদি সত্য হয় যে, প্ৰত্যক্ষবস্তুর সহিত সংস্রব ব্যতীত জ্ঞানই বলো, ভােবই বলো, চরিত্রই বলো, নিজীবি ও নিম্বফল হইতে থাকে, তবে আমাদের ছাত্রদের শিক্ষাকে সেই নিম্বফলতা হইতে যথাসাধ্য রক্ষা করিতে চেষ্টা করা অত্যাবশ্যক । বাংলাদেশ আমাদের নিকটতম— ইহারই ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতিকে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ আপনার আলোচ্য বিষয় করিয়াছেন । পরিষদের নিকট আমার নিবেদন এই যে, এই আলোচনাব্যাপারে তাহারা ছাত্ৰাদিগকে আহবান করিয়া লউন । তাহা হইলে প্ৰত্যক্ষবস্তুর সম্পর্কে ছাত্রদের বীক্ষণশক্তি ও মননশক্তি সবল হইয়া উঠিবে এবং নিজের চারি দিককে, নিজের দেশকে ভালো করিয়া জানিবার অভ্যাস হইলে অন্য সমস্ত জানিবার যথার্থ ভিত্তিপত্তন হইতে পরিবে । তা ছাড়া, নিজের দেশকে ভালো করিয়া জানার চর্চা নিজের দেশকে যথার্থভাবে প্রীতির চর্চার অঙ্গ । বাংলাদেশে এমন জিলা নাই যেখান হইতে কলিকাতায় ছাত্রসমাগম না হইয়াছে । দেশের সমস্ত বৃত্তান্তসংগ্রহে ইহাদের যদি সহায়তা পাওয়া যায়, তবে সাহিত্য-পরিষৎ সার্থকতা লাভ করিবেন। এ সাহায্য কিরূপ এবং তাহার কতদূর প্রয়োজনীয়তা তাহার দুই-একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতে পারে । বাংলাভাষায় একখানি ব্যাকরণ-রচনা সাহিত্য-পরিষদের একটি প্ৰধান কাজ । কিন্তু কাজটি সহজ নহে । এই ব্যাকরণের উপকরণ সংগ্ৰহ একটি দুরূহ ব্যাপার । বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলি উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ । আমাদের