পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

οι Σ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের সমাজে ব্রাহ্মণের কাজ পুনরায় আরম্ভ হইবে, এ সম্ভাবনাকে আমি সুদূরপরাহত মনে করি না এবং এই আশাকে আমি লঘুভাবে মন হইতে অপসারিত করিতে পারি না। ভারতবর্ষের চিরকালের প্রকৃতি তাহার ক্ষণকালের বিকৃতিকে সংশোধন করিয়া লইবেই। এই পুনর্জাগ্ৰত ব্ৰাহ্মণসমাজের কাজে অব্রাহ্মণ অনেকেও যোগ দিবেন। প্রাচীন ভারতেও ব্ৰাহ্মণেতার অনেকে ব্ৰাহ্মণের ব্ৰত গ্ৰহণ করিয়া জ্ঞানচর্চা ও উপদেষ্টার কাজ করিয়াছেন, ব্ৰাহ্মণও তাহাদের কাছে শিক্ষালাভ করিয়াছেন, এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই। প্রাচীনকালে যখন ব্ৰাহ্মণই একমাত্র দ্বিজ ছিলেন না, ক্ষত্ৰিয়-বৈশ্যও দ্বিজ-সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন, যখন ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া উপযুক্ত শিক্ষালাভের দ্বারা ক্ষত্ৰিয়-বৈশ্যের উপনয়ন হইত, তখনই এ দেশে ব্ৰাহ্মণের আদর্শ উজল ছিল। কারণ, চারি দিকের সমাজ যখন অবনত তখন কোনো বিশেষ সমাজ। আপনাকে উন্নত রাখিতে পারে না, ক্রমেই নিমের আকর্ষণ তাহাকে নীচের স্তরে লইয়া আসে । ভারতবর্ষে যখন ব্রাহ্মণই একমাত্র দ্বিজ অবশিষ্ট রহিল— যখন তাহার আদর্শ স্মরণ করাইয়া দিবার জন্য, তাহার নিকট ব্ৰাহ্মণত্ব দাবি করিবার জন্য, চারি দিকে আর কেহই রহিল না— তখন তাহার দ্বিজত্বের বিশুদ্ধ কঠিন আদর্শ দ্রুতবেগে ভ্ৰষ্ট হইতে লাগিল। তখনই সে জ্ঞানে বিশ্বাসে রুচিতে ক্রমশ নিকৃষ্ট অধিকারীর দলে আসিয়া উত্তীর্ণ হইল। চারি দিকে যেখানে গোলপাতার কুঁড়ে সেখানে নিজের বিশিষ্টতা রক্ষা করিতে হইলে একটা আটচালা বাধিলেই যথেষ্ট— সেখানে সাত-মহল প্ৰাসাদ নির্মাণ করিয়া তুলিবার ব্যয় ও চেষ্টা স্বীকার করিতে সহজেই অপ্ৰবৃত্তি জন্মে। প্রাচীনকালে ব্ৰাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয়-বৈশ্য দ্বিজ ছিল, অর্থাৎ সমস্ত আৰ্যসমাজই দ্বিজ ছিল ; শূদ্র বলিতে যে-সকল লোককে বুঝাইত তাহারা সঁওতাল ভিল কোল ধ্বঃ গুরের দলে ছিল। আৰ্যসমাজের সহিত তাহাদের শিক্ষা রীতিনীতি ও ধর্মের সম্পূৰ্ণ ঐক্যস্থাপন একেবারেই অসম্ভব ছিল। কিন্তু তাহাতে কোনো ক্ষতি ছিল না, কারণ, সমস্ত আৰ্যসমাজই দ্বিজ ছিল- অর্থাৎ আর্যসমাজের শিক্ষা একই রূপ ছিল। প্ৰভেদ ছিল কেবল কর্মে। শিক্ষা একই থাকায় পরস্পর পরস্পরকে আদর্শের বিশুদ্ধিরক্ষায় সম্পূৰ্ণ আনুকূল্য করিতে পারিত। ক্ষত্ৰিয় এবং বৈশ্য ব্ৰাহ্মণকে ব্ৰাহ্মণ হইতে সাহায্য করিত এবং ব্ৰাহ্মণও ক্ষত্ৰিয়-বৈশ্যকে ক্ষত্ৰিয়-বৈশ্য হইতে সাহায্য করিত । সমস্ত সমাজের শিক্ষার আদর্শ সমান উন্নত না হইলে এরূপ কখনোই ঘটিতে পারে না । বর্তমান সমাজেরও যদি একটা মাথার দরকার থাকে, সেই মাথাকে। যদি উন্নত করিতে হয় এবং সেই মাথাকে। যদি ব্ৰাহ্মণ বলিয়া গণ্য করা যায়, তবে তাহার স্কন্ধকে ও গ্রীবাকে একেবারে মাটির সমান করিয়া রাখিলে চলিবে না। সমাজ উন্নত না হইলে তাহার মাথা উন্নত হয় না, এবং সমাজকে সর্বপ্রযত্নে উন্নত করিয়া রাখাই সেই মাথার কাজ । আমাদের বর্তমান সমাজের ভদ্রসম্প্রদায়- অর্থাৎ বৈদ্য কায়স্থ ও বণিক-সম্প্রদায়— সমাজ যদি ইহাদিগকে দ্বিজ বলিয়া গণ্য না করে তবে ব্ৰাহ্মণের আর উত্থানের আশা নাই। এক পায়ে দাড়াইয়া সমাজ বকবৃত্তি করিতে পারে না। বৈদ্যেরা তো উপবীত গ্ৰহণ করিয়াছেন। মাঝে মাঝে কায়স্থেরা বলিতেছেন তাহারা ক্ষত্ৰিয়, বণিকেরা বলিতেছেন তাহারা বৈশ্য- এ কথা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখি না। আকারপ্রকার বুদ্ধি ও ক্ষমতা, অর্থাৎ আর্যত্বের লক্ষণে, বর্তমান ব্ৰাহ্মণের সহিত ইহাদের প্রভেদ নাই। বঙ্গদেশের যে-কোনো সভায় পইতা না দেখিলে, ব্ৰাহ্মণের সহিত কায়স্থ সুবর্ণবণিক প্রভৃতিদের তফাত । করা অসম্ভব। কিন্তু যথার্থ অনার্য অর্থাৎ ভারতবষীয় বন্যজাতির সহিত তাহাদের তফাত করা সহজ। বিশুদ্ধ আর্যরক্তের সহিত অনার্যরক্তের মিশ্রণ হইয়াছে, তাহা আমাদের বর্ণে আকৃতিতে ধর্মে আচারে ও মানসিক দুর্বলতায় স্পষ্ট বুঝা যায়— কিন্তু সে মিশ্রণ ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই রহিয়াছে। তথাপি এই মিশ্রণ এবং বৌদ্ধযুগের সামাজিক অরাজকতার পরেও সমাজ ব্ৰাহ্মণকে একটা বিশেষ গণ্ডি দিয়া রাখিয়াছে। কারণ, আমাদের সমাজের যেরূপ গঠন, তাহাতে ব্ৰাহ্মণকে নহিলে