পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a SS রবীন্দ্র-রচনাবলী প্রাদুর্ভাব নাই ? আমরা কি যথার্থ কথা স্পষ্ট করিয়া বলিতে শিখিতেছি? আমরা কি পরস্পর বলাবলি করি না যে, নিজের স্বার্থের জন্য যাহা দূষণীয় রাষ্ট্ৰীয় স্বার্থের জন্য তাহা গৰ্হিত নহে? কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰেই কি বলে না ?-- ধর্ম এব হতো। হন্তি ধর্মে রক্ষতি রক্ষিতঃ। তস্মাৎ ধর্মে ন হস্তব্যো মা নো ধর্মে হতো বাধীৎ ৷ ” বস্তুত প্রত্যেক সভ্যতারই একটি মূল আশ্রয় আছে। সেই আশ্রয়টি ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত কি না। তাহাই বিচাৰ্য। যদি তাহা উদার ব্যাপক না হয়, যদি তাহা ধর্মকে পীড়িত করিয়া বধিত হয়, তবে তাহার। আপাত-উন্নতি দেখিয়া আমরা তাহাকে যেন ঈর্ষা, এবং তাহাকেই একমাত্র ঈপ্সিত বলিয়া বরণ না করি। আমাদের হিন্দুসভ্যতার মূলে সমাজ, য়ুরোপীয় সভ্যতার মূলে রাষ্ট্রনীতি। সামাজিক মহত্ত্বেও মানুষ মাহাত্ম্য লাভ করিতে পারে, রাষ্ট্রনীতিক মহত্ত্বেও পারে। কিন্তু আমরা যদি মনে করি, যুরোপীয় ছাদে নেশন গড়িয়া তোলাই সভ্যতার একমাত্র প্রকৃতি এবং মনুষ্যত্বের একমাত্র লক্ষ্য — তবে আমরা ভুল বুঝিব। Cख्ार्छ > ○○br আমাদের দেশের কোনো বন্ধু অথবা বড়োলোকের মৃত্যুর পর আমরা বিশেষ কিছুই করি না । এইজন্য আমরা পরস্পরকে অনেকদিন হইতে অকৃতজ্ঞ বলিয়া নিন্দা করিতেছি— অথচ সংশোধনের কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। ধিককার যদি আন্তরিক হইত, লজ্জা যদি যথার্থ পাইতাম, তবে এতদিনে আমাদের ব্যবহারে তাহার কিছু-না-কিছু পরিচয় পাওয়া যাইত। কিন্তু কেন আমরা পরস্পরকে লজা দিই, অথচ লজা পাই না ? ইহার কারণ আলোচনা করিয়া দেখা কর্তব্য। ঘা মারিলে যদি দরজা না খোলে তবে দেখিতে হয়, তালা বন্ধ আছে কি না । স্বীকার করিতেই হইবে, মৃত মান্যব্যক্তির জন্য পাথরের মূর্তি গড়া আমাদের দেশে চলিত ছিল না। ; এইপ্ৰকার মাৰ্বল পাথরের পিগুদানপ্ৰথা আমাদের কাছে অভ্যস্ত নহে। আমরা হাহাকার করিয়াছি, অশ্রুপাত করিয়াছি, বলিয়াছি, “আহা, দেশের এত বড়ো লোকটাও গেল!”— কিন্তু কমিটির উপর স্মৃতিরক্ষার ভার দিই নাই। এখন আমরা শিখিয়াছি। এইরূপই কর্তব্য, অথচ তাহা আমাদের সংস্কারগত হয় নাই, এইজন্য কর্তব্য পালিত না হইলে মুখে লজ্জা দিই, কিন্তু হৃদয়ে আঘাত পাই না। ভিন্ন মানুষের হৃদয়ের বৃত্তি একরকম হইলেও বাহিরে তাহার প্রকাশ নানা কারণে নানারকম হইয়া থাকে। ইংরাজ প্রিয়ব্যক্তির মৃতদেহ মাটির মধ্যে ঢাকিয়া পাথরে চাপা দিয়া রাখে, তাহাতে নামধাম-তারিখ খুন্দিয়া রাখিয়া দেয় এবং তাহার চারি দিকে ফুলের গাছ করে। আমরা পরমাত্মীয়ের মৃতদেহ শ্মশানে ভস্ম করিয়া চলিয়া আসি। কিন্তু প্রিয়জনের প্ৰিয়ত্ব কি আমাদের কাছে কিছুমাত্ৰ অল্প ? ভালোবাসিতে এবং শোক করিতে আমরা জানি না, ইংরাজ জানে, এ কথা কবর এবং শ্মশানের সাক্ষ্য হইয়া ঘোষণা করিলেও হৃদয় তাহাতে সায় দিতে পারে না । ইহার অনুরূপ তর্ক এই যে, “থ্যাঙ্ক যুর প্রতিবাক্য আমরা বাংলায় ব্যবহার করি না, অতএব আমরা অকৃতজ্ঞ। আমাদের হৃদয় ইহার উত্তর এই বলিয়া দেয় যে, কৃতজ্ঞতা আমার যে আছে আমিই তাহা জানি, অতএব “থ্যাঙ্ক য়ু বাক্য-ব্যবহার যে কৃতজ্ঞতার একমাত্র পরিচয় তাহা হইতেই পারে না। “থ্যাঙ্ক য়ু শব্দের দ্বারা হাতে হাতে কৃতজ্ঞতা ঝাড়িয়া ফেলিবার একটা চেষ্টা আছে, সেটা আমরা জবাব-স্বরূপ বলিতে পারি। যুরোপ কাহারও কাছে বাধ্য থাকিতে চাহে না-- সে স্বতন্ত্র। কাহারও