পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ভারতবর্ষ। ava যাহা বিনষ্ট হইবার তাহাকে বিনষ্ট হইতে দিতে হইবে, যাহা অগ্নিতে দগ্ধ হইবার তাহা ভস্ম হইয়া যাক। মৃতদেহ যদি লুপ্ত না হইয়া যাইত। তবে পৃথিবীতে জীবিতের অবকাশ থাকিত না, ধরাতল একটি প্ৰকাণ্ড কবরস্থান হইয়া থাকিত। আমাদের হৃদয়ের ভক্তিকে পৃথিবীর ছোটাে এবং বড়ো, খাটি এবং কুঁটা, সমস্ত বড়োত্ত্বের গোরস্থান করিয়া রাখিতে পারি না। যাহা চিরজীবী তাঁহাই থাক; যাহা মৃতদেহ, আজ বাদে কাল কীটের খাদ্য হইবে, তাহাকে মুগ্ধ মেহে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা না করিয়াই শোকের সহিত, অথচ বৈরাগ্যের সহিত, শ্মশানে ভস্ম করিয়া আসাই বিহিত। পাছে ভুলি, এই আশঙ্কায় নিজেকে উত্তেজিত রাখিবার জন্য কল বানাইবার চেয়ে ভোলাই ভালো। ঈশ্বর আমাদিগকে দয়া করিয়াই বিস্মরণশক্তি দিয়াছেন। সঞ্চয় নিতান্ত অধিক হইয়া উঠিতে থাকিলে বাছাই করা দুঃসাধ্য হয়। তাহা ছাড়া সঞ্চায়ের নেশা বড়ো দুৰ্জয় নেশা। একবার যদি হাতে কিছু জমিয়া যায়, তবে জমাইবার ঝোক আর সামলানো যায় না। আমাদের দেশে ইহাকেই বলে নিরানব্বইয়ের ধাক্কা। যুরোপে একবার বড়োলোক জমাইতে আরম্ভ করিয়া এই নিরানব্বইয়ের আবর্তের মধ্যে পড়িয়া গেছে। যুরোপে দেখিতে পাই কেহ বা ডাকের টিকিট জমায়, কেহ বা দেশালাইয়ের বাক্সের কাগজের আচ্ছাদন জমায়, কেহ বা পুরাতন জুতা কেহ বা বিজ্ঞাপনের ছবি জমাইতে থাকে— সেই নেশার রোখি। যতই চড়িতে থাকে ততই এই-সকল জিনিসের একটা কৃত্রিম মূল্য অসম্ভবরাপে বাড়িয়া উঠে। তেমনি যুরোপে মৃত বড়োলোক জমাইবার যে-একটা প্রচণ্ড নেশা আছে তাহাতে মূল্যের বিচার আর থাকে না। কাহাকেও আর বাদ দিতে ইচ্ছা! করে না। যেখানে একটুমাত্র উচ্চতা বা বিশেষত্ব আছে সেইখানেই য়ুরোপ তাড়াতাড়ি সিঁদুর মাখাইয়া দিয়া ঘণ্টা নাড়িতে থাকে। দেখিতে দেখিতে দল জুটিয়া যায়। বস্তুত মাহত্যুের সঙ্গে ক্ষমতা বা প্ৰতিভার প্রভেদ আছে। মহাত্মারা আমাদের কাছে এমন একটি আদর্শ রাখিয়া যান, যাহাতে তাহাদিগকে ভক্তিভারে স্মরণ করিলে জীবন মহত্ত্বের পথে আকৃষ্ট হয়, কিন্তু ক্ষমতাশালীকে স্মরণ করিয়া আমরা যে ক্ষমতাপ্ৰাপ্ত হইতে পারি। তাহা নহে। ভক্তিভাবে শেকসপীয়রের স্মরণমাত্র আমাদিগকে শেকসপীিয়রের গুণের অধিকারী করে না, কিন্তু যথার্থভাবে কোনো সাধুকে অথবা বীরকে স্মরণ করিলে আমাদের পক্ষে সাধুত্ব বা বীরত্ব কিয়ৎপরিমাণেও সরল হইয়া আসে। তবে গুণিসম্বন্ধে আমাদের কী কর্তব্য ? গুণীকে তাহার গুণের দ্বারা স্মরণ করাই আমাদের স্বাভাবিক কর্তব্য। শ্রদ্ধার সহিত তানসেনের গানের চর্চা করিয়াই গুণমুগ্ধ গায়কগণ তানসেনকে যথার্থভাবে স্মরণ করে। ধ্রুপদ শুনিলে যাহার গায়ে জ্বর আসে সেও তানসেনের প্রতিমা গড়িবার জন্য চান্দা দিয়া ঐহিক পারিত্রিক কোনো ফললাভ করে এ কথা মনে করিতে পারি না। সকলকেই যে গানে ওস্তাদ হইতে হইবে এমন কোনো অবশ্যবাধ্যতা নাই। কিন্তু সাধুতা বা বীরত্ব সকলেরই পক্ষে আদর্শ। সাধুদিগের এবং মহৎকর্মে প্ৰাণবিসর্জনপর বীরদিগের স্মৃতি সকলেরই পক্ষে মঙ্গলকর। কিন্তু দল বাধিয়া ঋণশোধ করাকে সেই স্মৃতি-পালন কহে না ; স্মরণব্যাপার প্রত্যেকের পক্ষে প্রত্যহের কর্তব্য। য়ুরোপে এই ক্ষমতা এবং মাহান্ত্র্যের প্রভেদ লুপ্তপ্রায়। উভয়েরই জয়ধ্বজা একই রকম, এমন-কি, মাহান্ত্র্যের পতাকাই যেন কিছু খাটাে। পাঠকগণ অনুধাবন করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পরিবেন, বিলাতে অভিনেতা আর্ভিঙের সম্মান পরমসাধুর প্রাপ্য সম্মান অপেক্ষা অল্প নহে। রামমোহন রায় আজ যদি ইংলন্ডে যাইতেন তবে তাহার গৌরব ক্রিকেট-খেলোয়াড় রঞ্জিতসিংহের গৌরবের কাছে খর্ব হইয়া থাকিত । আমরা কবিচরিত-নামক প্রবন্ধে উল্লেখ করিয়াছি, য়ুরোপে ক্ষমতাশালী লোকের জীবনচরিত লেখার একটা নিরতিশয় উদ্যম আছে। যুরোপকে চরিতবায়ুগ্ৰস্ত বলা যাইতে পারে। কোনোমতে একটা যে-কোনো প্রকারের বড়োলোকত্বের সুদূর গন্ধটুকু পাইলেই তাহার সমস্ত চিঠিপত্র, গল্পগুজব, প্রাত্যহিক ঘটনার সমস্ত আবর্জনা সংগ্ৰহ করিয়া মোটা দুই ভলু্যমে জীবনচরিত লিখিবার জন্য লোকে হা করিয়া বসিয়া থাকে। যে নাচে তাহার জীবনচরিত, যে গান করে তাহার জীবনচরিত, যে হাসাইতে Հ || 8 Գ