পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ( Օ রবীন্দ্র-রচনাবলী পৃথিবীর উপর প্রলয়পুচ্ছ সঞ্চালন করিয়া ফিরিয়াছিল। পৃথিবীর মধ্যে যে কোণে ক্ষুধার বেগ বা ক্ষমতার লালসা ক্রমাগত পোষিত হইতে থাকে সেই কোণ হইতে জগদবিনাশী ঝড় উঠিবেই। প্ৰাচীনকালে এই ধ্বংসধবজা তুলিয়া গ্ৰীক-রোমক-পারসীকগণ অনেক রক্ত সেচন করিয়াছে। ভারতবর্ষ বৌদ্ধ-রাজাদের অধীনে বিদেশে আপনি ধর্ম প্রেরণ করিয়াছে, আপনি স্বার্থ বিস্তার করে নাই । ভারতবর্ষীয় সভ্যতায় বিনাশপ্লাবনের বেগ কোনোকালে ছিল না । ক্ষমতা ও স্বার্থ -বিস্তার ভারতবর্ষীয় সভ্যতার ভিত্তি নহে। যুরোপীয় সভ্যতার ভিত্তি তাঁহাই। তাহা সর্বপ্রযত্নে নানা আকারে নানা দিক হইতে আপনার ক্ষমতাকে ও স্বার্থকেই বলীয়ান করিবার চেষ্টা করিতেছে। স্বার্থ ও ক্ষমতাম্পূহ কোনোকালেই নিজের অধিকারের মধ্যে নিজেকে রক্ষা করিতে পারে না— এবং অধিকারীলঙঘনের পরিণামফল নিঃসংশয় বিপ্লব । ইহা ধর্মের নিয়ম, ইহা ধ্রুব। সমস্ত যুরোপ আজ অস্ত্ৰে-শস্ত্রে দস্তুর হইয়া উঠিয়াছে। ব্যবসায়াবুদ্ধি তাহার ধর্মবুদ্ধিকে অতিক্রম করিতেছে। আমাদের দেশে বিলাতি সভ্যতার এমন-সকল পরম ভক্ত আছেন র্যাহারা ধর্মকে অবিশ্বাস যাহা-কিছু দেখিতেছ। এ-সমস্ত কিছুই নহে— দুই দিনেই কাটিয়া যাইবে। তাহারা বলেন, য়ুরোপীয় সভ্যতার রক্তচক্ষু এঞ্জিনটা সার্বজনীন ভ্ৰাতৃত্বের পথে ধকধক শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে। এরূপ অসামান্য অন্ধভক্তি সকলের কাছে প্রত্যাশা করিতে পারি না। সেইজন্যই পূর্বদেশের হৃদয়ের মধ্যে আজ এক সুগভীর চাঞ্চল্যের সঞ্চার হইয়াছে। আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় পাখি। যেমন আপন নীড়ের দিকে ছোটে, তেমনি বায়ুকোণের রক্তমেঘ দেখিয়া পূৰ্বদেশ হঠাৎ আপনার নীড়ের সন্ধানে উড়িবার উপক্রম করিয়াছে; বািজগর্জনকে সে সার্বভৌমিক প্রেমের মঙ্গলশঙ্খধ্বনি বলিয়া কল্পনা করিতেছে না। য়ুরোপ ধরণীর চারি দিকেই আপনার হাত বাড়াইতেছে ; তাহাকে প্ৰেমালিঙ্গনের বাহুবিস্তার মনে করিয়া প্রাচ্যখণ্ড পুলকিত হইয়া উঠিতেছে না। এই অবস্থায় আমরা বিলাতি সভ্যতার যে সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি তাহা কেবলমাত্র আত্মরক্ষার আকাঙক্ষায়। আমরা যদি সংবাদ পাই যে, বিলাতি সভ্যতার মূল্যকাণ্ড যে পলিটিকস, সেই পলিটিকস হইতে স্বার্থপরতা নির্দয়তা ও অসত্য, ধনাভিমান ও ক্ষমতাভিমান, প্রত্যহ জগৎ জুড়িয়া শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিতেছে, এবং যদি ইহা বুঝিতে পারি যে স্বার্থকে সভ্যতার মূলশক্তি করিলে এরূপ দারুণ পরিণাম একান্তই অবশ্যম্ভাবী, তবে সে কথা সৰ্ব্বতোভাবে আলোচনা করিয়া দেখা আবশ্যক হইয়া পড়ে— পরকে অপবাদ দিয়া সাস্তুনা পাইবার জন্য নহে, নিজেকে সময় থাকিতে সংযত করিবার জন্য। আমরা আজকাল পলিটিকস অর্থাৎ রাষ্ট্রগত একান্ত স্বার্থপরতাকেই সভ্যতার একটিমাত্ৰ মুকুটমণি ও বিরোধপরতাকেই উন্নতিলাভের একটিমাত্র পথ বলিয়া ধরিয়া লইয়াছি, আমরা পলিটিকসের মিথ্যা ও দোকানদারির মিথ্যা বিদেশের দৃষ্টান্ত হইতে প্রতিদিন গ্রহণ করিতেছি, আমরা টাকাকে মনুষ্যত্বের চেয়ে বড়ো এবং ক্ষমতা লাভকে মঙ্গলব্ৰতাচরণের চেয়ে শ্রেয় বলিয়া জানিয়াছি- তাই এতকাল যে স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের দেশে লোকহিতকর কর্ম ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হইতেছিল তাহা হঠাৎ বন্ধ হইয়া গেছে। ইংরেজ গোয়ালা বাটে হাত না দিলে আমাদের কামধেনু আর একফোটা দুধ দেয় না— নিজের বাছুরকেও নহে। এমনি দারুণ মোহ আমাদিগকে আক্রমণ করিয়াছে। সেই মোহজাল ছিন্ন করিবার জন্য যে-সকল তীক্ষবাক্য প্রয়োগ করিতে হইতেছে, আশা করি, তাহা বিদ্বেষবুদ্ধির অস্ত্রশালা হইতে গৃহীত হইতেছে না ; আশা করি, তাহা স্বদেশের মঙ্গল -ইচ্ছা হইতে প্রেরিত । আমরা গালি খাইয়া যদি জবাব দিতে উদ্যত হইয়া থাকি সে জবাব বিদেশী গালিদাতার উদ্দেশে নহে- সে কেবল আমাদের নিজের কাছে নিজের সম্মান রাখিবার জন্য, আমাদের নিজের প্রতি ভগ্নপ্রবণ বিশ্বাসকে বাধিয়া তুলিবার জন্য, শিশুকাল হইতে বিদেশীকে একমাত্র গুরু বলিয়া মানা অভ্যাস