পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছড়িয়ে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসল যখন, কুমু তার শিয়রের কাছে বসে ধীরে ধীরে তার চুলের মধ্যে হাত বুলোতে বুলোতে বললে, “দাদা, তোমার তালুক তুমি পত্তনি দিতে পারবে না।” “তোকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ভূতে পেয়েছে নাকি ? সব কথাতেই জুলুম ?” “না দাদা, কথা চাপা দিয়ে না।” তখন বিপ্রদাস আর থাকতে পারলে না, সোজা হয়ে উঠে বসে কুমুকে শিয়রের কাছ থেকে সরিয়ে সামনে বসালে। রুদ্ধ স্বরটাকে পরিষ্কার করবার জন্যে একটুখানি কেশে নিয়ে বললে, “স্থবোধ কী লিখেছে জানিস ? এই দেখ ।” এই বলে জামার পকেট থেকে তার চিঠি বের করে কুমুর হাতে দিলে । কুমু সমস্তটা পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে বললে, “মাগো, ছোড়দাদা এমন চিঠিও লিখতে পারলে ?” বিপ্রদাস বললে, “ওর নিজের সম্পত্তি আর আমার সম্পত্তিতে ও যখন আজি ভেদ করে দেখতে পেরেছে তখন আমার তালুক আমি কি আর আলাদা রাখতে পারি? আজ ওর বাপ নেই, বিপদের সময়ে আমি ওকে দেব না তো কে দেবে ?” এর উপর কুমু আর কথা কইতে পারলে না, নীরবে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বিপ্রদাস তাকিয়ায় আবার ঠেস দিয়ে চোখ বুজে রইল। অনেকক্ষণ দাদার পায়ে হাত বুলিয়ে অবশেষে কুমু বললে, “দাদা, মায়ের ধন তো এখন মায়েরই আছে, তার সেই গয়না থাকতে তুমি কেন—” বিপ্রদাস আবার চমকে উঠে বসে বললে, “কুমু, এটা তুই কিছুতে বুঝলি নে, তোর গয়না নিয়ে স্থবোধ আজ যদি বিলেতে থিয়েটার-কনসার্ট দেখে বেড়াতে পারে তা হলে আমি কি তাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারব— না সে কোনোদিন মুখ তুলে দাড়াতে পারবে ? তাকে এত শাস্তি কেন দিবি ?” কুমু চুপ করে রইল, কোনো উপায় সে খুজে পেল না। তখন, অনেকবার যেমন ভেবেছে তেমনি করেই ভাবতে লাগল— অসম্ভব কিছু ঘটে না কি ? আকাশের কোনো গ্রহ, কোনো নক্ষত্র এক মুহূর্তে সমস্ত বাধা সরিয়ে দিতে পারে না ? কিন্তু শুভলক্ষণ দেখা দিয়েছে যে, কিছুদিন থেকে বার বার তার বা চোখ নাচছে। এর পূর্বে জীবনে আরও অনেকবার বা চোখ নেচেছে, তা নিয়ে কিছু ভাববার দরকার হয় নি। এবারে লক্ষণটাকে মনে মনে ধরে পড়ল । যেন তার প্রতিশ্রুতি তাকে রাখতেই হবে— শুভলক্ষণের সত্যভঙ্গ যেন না হয় । GD|| N. 8