পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ २०¢ না যেতে মহারাজ হবেন এটা একেবারে লাটসাহেবের নিজ মুখের কথা । তাই এতদিন পরে তার ভাবনা ধরেছে, মহারানীর পদ এখন আর খালি রাখা চলবে না। আপনাদের গ্রহাচার্য কিছু ভটচাজ দূরসম্পর্কে আমার সম্বন্ধী, তার কাছে কন্যার কুষ্ঠি দেখা গেল— লক্ষণ ঠিকটি মিলেছে। এই নিয়ে শহরের মেয়ের কুষ্ঠি ঘাটতে বাকি রাখি নি— এমন কুষ্ঠি আর-একটিও হাতে পড়ল না। এই দেখে নেবেন, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এ সম্বন্ধ হয়েই গেছে, এ প্রজাপতির নির্বন্ধ । ঠিক এই সময়ে কুমুর আবার বা চোখ নাচল। শুভলক্ষণের কী অপূর্ব রহস্য! কিন্তু আচার্ষি কতবার তার হাত দেখে বলেছে, রাজরানী হবে সে । করকোষ্ঠির সেই পরিণত ফলটা আপনি যেচে আজ তার কাছে উপস্থিত । ওদের গ্রহাচার্য এই কদিন হল বার্ষিক আদায় করতে কলকাতায় এসেছিল ; সে বলে গেছে, এবার আষাঢ় মাস থেকে বৃষরাশির রাজসম্মান, স্ত্রীলোকঘটিত অর্থলাভ, শত্রুনাশ ; মন্দের মধ্যে পত্নীপীড়া, এমন-কি হয়তো পত্নীবিয়োগ। বিপ্রদাসের বৃষরাশি। মাঝে মাঝে দৈহিক পীড়ার কথা আছে। তারও প্রমাণ হাতে হাতে, কাল রাত থেকে স্পষ্টই সর্দির লক্ষণ। আষাঢ় মাসও পড়ল— পত্নীর পীড়া ও মৃত্যুর কথাটা ভাববার আশু প্রয়োজন নেই, অতএব এবার সময় ভালো । কুমু দাদার পাশে বসে বললে, "দাদা মাথা ধরেছে কি ?” দাদা বললে, “না।” “চা তো ঠাণ্ড হয়ে যায় নি ? তোমার ঘরে লোক দেখে ঢুকতে পারলুম না।” বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা সবচেয়ে অসহ, যখন সে সোনার রথ আনে যার চাকা অচল। দাদার মুখভাবে এই দ্বিধার বেদনা কুমুকে ব্যথা দিলে। দৈবের দানকে কেন দাদা এমন করে সন্দেহ করছেন ? বিবাহ-ব্যাপারে নিজের পছন্দ বলে যে একটা উপসর্গ অাছে এ চিন্তা কখনও কুমুদিনীর মাথায় আসে নি। শিশুকাল থেকে পরে পরে সে তার চার দিদির বিয়ে দেখেছে। কুলীনের ঘরে বিয়ে—কুল ছাড়া আর বিশেষ কিছু পছন্দর বিষয় ছিল তাও নয়। ছেলেপুলে নিয়ে তবু তারা সংসার করছে, দিন কেটে যাচ্ছে। যখন দুঃখ পায় বিদ্রোহ করে না ; মনে ভাবতেও পারে না যে কিছুতেই এটা ছাড়া আর কিছুই হতে পারত। মা কি ছেলে বেছে নেয় ? ছেলেকে মেনে নেয়। কুপুত্রও হয় স্থপুত্রও হয়। স্বামীও তেমনি। বিধাতা তো দোকান খোলেন নি। ভাগ্যের উপর বিচার চলবে কণর ? এতদিন পরে কুমুর মন্দভাগ্যের তেপাস্তর মাঠ পেরিয়ে এল রাজপুত্র ছদ্মবেশে ।