পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ २२> বানানো । বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “কখন বর এল? বাজনাবাদ্ব্যির আওয়াজ তে৷ পাওয়া গেল না।” সংবাদদাতা শিৰু বললে, “আমাদের জামাই বড়ো বিবেচক— বাড়িতে অসুখ শুনেই সব থামিয়ে দিয়েছে— বরযাত্রদের পায়ের শব্দ শোনা যায় না, এমনি ঠাণ্ড ।” “ওরে শিবু, খাবার জিনিস তো কুলিয়েছিল ? আমার ওই এক ভাবনা ছিল, এ তো কলকাতা নয় ।” “কুলোয় নি ? বলেন কী হুজুর ! কত ফেলা গেল। আরও অতগুলো লোককে খাওয়াবার মতো জিনিস বাকি আছে।”

  • ওরা খুশি হয়েছে তো ?” “একটি নালিশ কারও মুখে শোনা যায় নি। একেবারে টু শব্দটি না। আরও তো এত এত বিয়ে দেখেছি, বরযাত্রের দাপাদাপিতে কন্যাকর্তার ভির্মি লাগে । এরা এমনি চুপ, আছে কি না-আছে বোঝাই যায় না।”

বিপ্রদাস বললে, “ওরা কলকাতার লোক কিনা, তাই ভদ্র ব্যবহার জান৷ আছে । ওরা বোঝে যে, যে বাড়ি থেকে মেয়ে নেবে তাদের অপমানে নিজেদেরই অপমান ।” “আহ, হুজুর যা বললেন এই কথাটি ওদের লোকজনদের আমি শুনিয়ে দেব। শুনলে ওরা খুশি হবে।” কুমু কাল সন্ধের সময়েই বুঝেছিল অস্থখ বাড়বার মুখে। অথচ সে যে দাদার সেবা করতে পারবে না এই দুঃখ সৰ্বক্ষণ তার বুকের মধ্যে ফাদে-পড়া পাখির মতো ছটফটু করতে লাগল। তার হাতের সেবা যে তার দাদার কাছে ওষুধের চেয়ে বেশি। স্বান করে ঠাকুরকে ফুল দিয়ে কুমু যখন দাদার ঘরে এল তখনও সূর্য ওঠে নি। কঠিন রোগের সঙ্গে অনেকক্ষণ লড়াই করে ক্ষণকাল ছুটি পাবার সময় যে অবসাদের বৈরাগ্য আসে সেই বৈরাগ্যে বিপ্রদাসের মন তখন শিথিল। জীবনের আসক্তি, সংসারের ভাবনা সব তার কাছে শস্যশূন্ত মাঠের মতো ধূসরবর্ণ। সমস্ত রাত দরজা বন্ধ ছিল, ডাক্তার ভোরের বেলায় পুব দিকের জানালাটা খুলে দিয়েছে। অশথগাছের শিশির-ভেজা পাতার আড়ালে অরুণবর্ণ আকাশের আভা ধীরে ধীরে শুভ্র হয়ে আসছে— অদূরবর্তী নদীতে মহাজনি নৌকোর বৃহৎ তালি-দেওয়া পালগুলি সেই আরক্তিম আকাশের গায়ে স্ফীত হয়ে উঠল। নহবতে করুণ স্বরে রামকেলি বাজছে ।