পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ S8 কুমুর সাজসজ্জা হল। ঠাট্টার সম্পৰ্কীয়দের ঠাট্টার পালা শেষ হয়েছে— নিমন্ত্রিতদের খাওয়ানো শুরু হবে। মধুসূদন আগে থাকতেই বলে রেখেছিল, বেশি রাত করলে চলবে না, কাল ওর কাজ আছে। ন-টা বাজবামাত্রই হুকুমমতো নীচের উঠোন থেকে সশব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। আর এক মুহূর্ত না । সময় অতিক্রম করবার সাধ্য কারও নেই। সভা ভঙ্গ হল। আকাশ থেকে বাজপাখির ছায়া দেখতে পেয়ে কপোতীর যেমন করে, কুমুর বুকটা তেমনি কাপতে লাগল। তার ঠাণ্ডা হাত ঘামছে, তার মুখ বিবর্ণ। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই মোতির মার হাত ধরে বললে, “আমাকে একটুখানির জন্যে কোথাও নিয়ে যাও আড়ালে। দশ মিনিটের জন্যে একলা থাকতে দাও।” মোতির মা তাড়াতাড়ি নিজের শোবার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলে। বাইরে দাড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললে, “এমন কপালও করেছিলি।” দশ মিনিট যায়, পনেরো মিনিট যায়। লোক এল— বর শোবার ঘরে গেছে, বউ কোথায় ? মোতির মা বললে, “অত ব্যস্ত হলে চলবে কেন ? বউ গায়ের জামাগয়নাগুলো খুলবে না ?” মোতির মা যতক্ষণ পারে ওকে সময় দিতে চায়। অবশেষে যখন বুঝলে আর চলবে না তখন দরজা খুলে দেখে, বউ মূৰ্ছিত হয়ে মেজের উপর পড়ে আছে। গোলমাল পড়ে গেল। ধরাধরি করে বিছানার উপর তুলে দিয়ে কেউ জলের ছিটে দেয়, কেউ বাতাস করে। কিছুক্ষণ পরে যখন চেতন হল, কুমু বুঝতে পারলে না কোথায় সে আছে— ডেকে উঠল, "দাদা।” মোতির মা তাড়াতাড়ি তার মুখের উপর ঝুকে পড়ে বললে, “ভয় নেই দিদি, এই যে আমি আছি।” বলে ওর মুখটা বুকের উপর তুলে নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। সবাইকে বললে, “তোমরা ভিড় কোরে না, আমি এখনই ওকে নিয়ে যাচ্ছি।” কানে কানে বলতে লাগল, “ভয় করিস নে ভাই, ভয় করিস নে।” কুমু ধীরে ধীরে উঠল। মনে মনে ঠাকুরের নাম করে প্রণাম করলে। ঘরের অন্য পাশে একটা তক্তাপোশের উপর হাবলু গভীর ঘুমে মগ্ন— তার পাশে গিয়ে তার কপালে চুমে খেলে। মোতির মা তাকে শোবার ঘর পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এখনও ভয় করছে দিদি ?” কুমু হাতের মুঠে শক্ত করে একটু হেসে বললে, “না, আমার কিছু ভয় করছে না।” মনে মনে বলছে, “এই আমার অভিসার, বাইরে অন্ধকার ভিতরে আলো।’ মেরে গিরিধর গোপাল, ঔর নাহি কোহি।